Phoenix

কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প

পর্ব-১

কাউকে ভালোবাসলে আমরা নিজেকে উজাড় করে ভালবাসার সেই মানুষটাকে সবটুকু দিয়ে দেই۔ যেন” প্রাণ দিতে চাই মন দিতে চাই সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই” গানের মতো।
জীবনদেবতা বলে তাঁর পায়ে নিজেকে ভালো রাখবার চাবিটিও তুলে দেই সসম্মানে।
তারপরে কিন্তু কাউন্সেলিং টেবিলের একই গল্প।
সেই মানুষটি আমাদের ‘Taken for granted’ হিসেবে ধরে এমন সব আচরণ করতে থাকে যার পরিণতিতে বোবা কষ্টে চোখের পানি ঝরানো ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প পথই থাকে না; এমন মানুষদের ভাবনার জায়গাটায় হয়তো কাজ করে ‘আমি টাকা দেই তাই আমার কথা না মেনে যাবে কই’ বা ‘আমি তোমার need fulfill করি তাই আমার বৃত্তের বাইরে পালাবে কই ?’ আর ঠিক তখনি রূপকথার ভালোবাসা পরিণত হয় দাসত্বের অসম্মানজনক ধ্বংসস্তূপে।
একটি বার চোখ বন্ধ করে ভাবুনতো কতবার, কার কার কাছে এই জীবনে ‘Taken for granted’ হয়েছেন?
তাই নিজের অনুভূতিগুলিকে সন্মান করুন; নিজেকে ভালো রাখবার চাবি নিজের হাতে রাখুন۔ ভালোবাসেন বলে তাঁর দেয়া কতটুকু আঘাত সহ্য করবেন একবার নিজের মনের চোখে চোখ রেখে ভাবুন।
যাঁরা অন্যকে “Taken for granted” না ভেবেই ভালোবাসতে পারেন তাঁদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
 

পর্ব-২

মেয়েটি ডাক্তার۔ বিয়ে করেছিল নিজ পছন্দে۔ তাই বাবা বাড়ি থেকে ত্যাজ্য۔ যেই স্বপ্নের অঞ্জন চোখে মেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল সেই মাধুর্য্য মেহেদির রং মিলানোর আগেই গায়ে হাত তোলার মাধ্যমে শেষ হয়েছিলো۔ শ্বশুর বাড়ির শাসন আর নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমত্তিক۔
এরপর সেই পুরাতন কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এমনিই এখন বিশ্বব্যাপী তুঙ্গে۔ এমন সময় কদিন আগে রাতে মেয়েটাকে শ্বাশুড়ি বাড়ি ঢুকতে দেয় নাই কারণ সে নাকি ইচ্ছা করে রাতে ডিউটি নিয়ে অসভ্যতামি করে এসেছে۔
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে প্রশ্ন করলো, “আমাকে বাপে খেদানো মা’য়ে তাড়ানো বলে, যার জন্য সবাইকে ছাড়লাম সেই আমাকে নিজের মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে চরিত্রহীন বলে, আপনি বলেন আমার কি বেঁচে থাকবার আর কোন কারণ আছে ?”
মেয়েটি যখন এই প্রশ্নটি করলো তখন তার চিন্তা চেতনায় গোটা দুনিয়াতে কেবল অস্তিত্ব ছিল তার জামাই আর শ্বশুর বাড়ির۔ সে ভুলে গিয়েছিলো যে এই পৃথিবীতে কিন্তু সে’ও থাকে আবার তাঁর অনেক প্রিয় মানুষও থাকে۔ যাঁদের কাছে সে অনেক আদরের۔
আসলে কিন্তু মেয়েটি সুযোগ দিয়েছিলো বলেই ওরা দিনের পর দিন এতো অসম্মান মেয়েটাকে করতে পারলো۔ এই টক্সিক রিলেশনশিপগুলির যাতনা কি আদৌতেই এতদিন বয়ে বেড়াবার কোন দরকার ছিল যেখানে বেলাশেষে বেঁচে থাকাটাই বোঝা মনে হয়? বাইরের কেউ বিষ দিলেই কি আমি বিষ খাবো?
মানুষ মাত্রই ভুল করে۔ আবার মানুষেরই তা শুধরে নেবার ক্যাপাসিটি আছে۔ ওই যে একটা গান ছিল না, “তোলো ছিন্ন বীনা বাঁধ নতুন সুরে”
প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের নতুনের মাঝে চিরপুরাতন সেই ‘ভিতরের আমি’কে নতুন সুর শোনার সম্মানজনক সুযোগ করে দেই ?
যাঁরা অন্যকে যে যেমন আছেন, সেভাবেই সন্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔

পর্ব-৩

মেয়েটার বাবা একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন۔ এই ক্রান্তিকালের আঁচ লেগেছে ওদের মা, বাবা আর নিজেকে নিয়ে গোছানো ছোট্ট ছিমছাম সংসারেও۔
ঠিকা বুয়া বিদায় হয়েছে বেশ কিছু দিন থেকে۔ মা তাই অবিশ্রান্ত ব্যস্ত ঘরের কাজে۔ সারাদিনে ঘরে কত যে অদৃশ্য কাজ থাকে একজন গৃহকত্রীই শুধু সেটা বুঝতে পারেন۔
এইদিকে বেতন কমে গিয়েছে বলে বাবার কপালে চিন্তার রেখা, বাবার হোম অফিসের সময় অফিসের সম্ভাব্য ছাটাইয়ের গুঞ্জন কিছুই চোখ এড়ায় না মেয়েটার۔
এই করোনাকালীন সময় স্কুলে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে কিন্তু ওর বহু পুরাতন সেই কোনা ভাঙা ট্যাবে সাউন্ড আসলে ভিডিও আসে না۔ বাসায় একটাই ল্যাপটপ সেটা বাবার দখলে۔
মেয়েটা একবার ভাবে বাবাকে অনলাইন ক্লাসের জন্য নতুন কম্পিউটার চাইবে۔ আবার ভাবে এতোগুলি টাকা এই দুর্দিনের বাজারে খরচ করাবে? বাবার চাকরি চলে গেলে কি হবে? অথচ কিছুদিন আগেও কিন্তু ওর ভাবনায় ছিল রোজার ঈদে বিদেশে কই ঘুরতে যাবে۔
এরপর সেই পুরাতন কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
নিঃসঙ্গতা কমাতে মেয়েটি নিজ ভুবনে জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত বাবা মা’র থেকে আস্তে আস্তে যতটা দূরত্ব বেড়েছে পাল্লা দিয়ে ঠিক ততোটাই বেড়েছে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের সংখ্যা۔
মা সারাদিনে নানান কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের দিকে উঁকি দিয়ে ভেবেছেন যাক মেয়ে তো নিজের মনেই আছে নিরাপদ ঘরের কোনে۔ অথচ আজন্ম তুলু তুলু ভাবে বেড়ে ওঠা অসূর্যস্পর্শা মেয়েটি যে কত ভিডিও চ্যাট বা ইনবক্সে ছবি শেয়ারের অফার পেলো একই ছাদের নিচে কেউ জানলো না۔
তারপর গৎবাঁধা cyber bullying এর খেলা۔ হয় টাকা দাও নাইলে ছবি ভাইরাল করে দেব ۔
মা চোখে পানি নিয়ে বলেন, ” আপা, কি করি নাই মেয়ের জন্য? নিজের ভালো চাকরিটা পর্যন্ত ছেড়েছি, সেটা কি এই দিন জন্য?”
মেয়ে আপাত রাগ আর ভিতরে অসহায়ত্ব নিয়ে বলছে , ‘আমাকে বাবা মা কেউ বোঝে না ۔”
বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন সামাজিক মানসন্মান বাঁচিয়ে এই জিম্মি দশা থেকে মুক্তির উপায়۔
বাবা মা’র সাথে খোলাখুলি হতাশা, কষ্ট, আনন্দ বেদনাগুলি ভাগ করে নেয়া এই কঠিন সময়ে অনেক বেশি প্রয়োজন۔ সেই সুযোগটা দিতে বড়দেরই একধাপ এগিয়ে আসতে হবে۔
বাচ্চাদের মাথায় আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিতে হবে পরিবারের থেকে বেশি কেউ কিন্তু আমার বিপদে এগিয়ে আসবে না۔ এর জন্য প্রয়োজন বাবা মা’ র দরকার নন জাজমেন্টাল হয়ে বাচ্চাদের কথাগুলি শোনা۔ কথায় কথায় বাচ্চাদের উপদেশ দেবার দরকার নেই۔ ওকে ওর মতো শিখতে দিন۔ ও আলাদা মানুষ۔ ওর ভালো লাগা মন্দ লাগা একদম আলাদা۔ সেটা আমি বাবা বা মা বলে আমার ঘড়ি ধরে চলে না۔
বড়দের ভুবনে অনেক মানুষ তাই ঠেকে ঠেকে শিখেই আস্তে আস্তে বড়দের অভিজ্ঞতার ঝুলি সম্মৃদ্ধ হয়۔ অন্যদিকে বাচ্চাদের পৃথিবীতে মানুষ হাতে গোনা۔ ভুল তাঁরা করবে এটাই স্বাভাবিক۔ আসুন বাচ্চাদের ছোট ছোট ভুল করবার সুযোগ দেই এতে 3টা লাভ হবে,
1. ভুল থেকে ঠেকে নিজে নিজেই শিখবে তাই পরেরবার এই ভুল করবে না۔
2. আপনার জানার মধ্যে নতুন কিছু করতে যেয়ে ভুল করছে, যেহেতু আপনি জানেন এর মাশুল বাচ্চার জন্য অনেক পেইনফুল না তাই সেই কাজটা ওর ইচ্ছা মতো করবার সুযোগ দিলেন নন জাজমেন্টাল ভাবে ফলে আপনার সাথে তার আস্থার জায়গা মজবুত হবে۔
3. বড় কোন বিপদে পড়বার আগেই আপনি তাকে সতর্ক ও প্রয়োজনে রক্ষা করতে পারবেন۔
বাচ্চাদের মতামতের ভিন্নতাকে সন্মান করুন۔
এদ্দিন যদি এভাবে না ভাবি আজ থেকে ভাবতে দোষ কি ?
যাঁরা অন্যদের ভিন্নতা কে নিজের মতের অমিল থাকা স্বত্বেও বিচারকের দৃষ্টিতে ঠিক বেঠিকের তুল্যদন্ডে বিচার করেন না তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔ কারণ আমিই যে সবসময় সঠিক এটা কে বললো?

পর্ব-৪

Eric Berne used to say that ” We are all born as princes and princesses and that life and our experiences in it transform us into frogs. “
আসলেই আমরা সবাই রাজকন্যা বা রাজপুত্র হয়েই জন্ম নেই ۔ তারপর দিনযাপনের ক্লান্তি, গ্লানি, অসহায়ত্ব আস্তে আস্তে আমাদেরকে একটু একটু করে রূপকথার সেই কুৎসিত বাঙে রূপান্তরিত করে۔ আমরা প্রতিদিন মনের অদৃশ্য আগুনে অল্প অল্প করে পুড়ে ছাই হই۔
এই রাজকন্যা/পুত্র থেকে বাঙে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই۔ যখন পরীক্ষায় খারাপ নম্বর পেলে মা বলেতেন অমুকের পা ধোয়া পানি খা; বা যখন সুন্দরী বা বড়লোকের হাত ধরে প্রেমিক/প্রেমিকা ছেড়ে যায়; অথবা জীবনসঙ্গী পরকীয়ায় ঝুঁকে তখন۔
এভাবেই প্রতিটা রিজেকশনে মনের পৃথিবীতে আমরা ব্যাঙ হই ধীরে ধীরে۔ হারিয়ে ফেলি কৈশোরের মুগ্ধতা,আনন্দ পাওয়ার সুরগুলি۔
তারপর সেই পুরাতন কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
আমরা নিজে ক্ষত বিক্ষত হই. কাছের মানুষগুলির সাথে একই ছাদের তলায় থেকেও মানসিক ভাবে নির্বাসিত হই একলা দ্বিপে ۔
ঠিক যেমন আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েটির বাবার আমার কাছে আত্মউপলব্ধি, ” হিংস্র হয়ে গেছি, মেয়ের গায়ে হাত তুলবো স্বপ্নেও ভাবি নাই , আজকাল মারি, গালি দেই, মেয়েটা এখন আমার সামনে কাঁদেও না, যদি বিরক্ত হই۔”
কাউন্সেলিং কিন্তু মেয়েটির থেকেও বাবাটার বেশি দরকার কারণ উনি দীর্ঘ দিন ব্যাঙ হতে হতে সেই নিষ্ঠুর আঁচে তার উপর ডিপেন্ডেন্ট মানুষগুলিকেও কুলকাঠের চিতায় পোড়াচ্ছেন۔
অন্যের দেয়া কষ্ট থাকবেই۔ কিন্তু তার দহনে আমি ব্যাঙ হবো কিনা এই সিদ্ধান্ত শুধু আমার۔
এখন থেকে আপনি কি করবেন?
গতানুগতিক ব্যাঙ হবার রাস্তায় হাঁটবেন?
নাকি,
‘ভিতরের আমি’র রাজকন্য/পুত্র থাকার ভুলে যাওয়া ট্রেইল খুঁজবেন?
যাঁরা তাঁর থেকে নিচু পদমর্যাদার মানুষকে সন্মান করেন তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔

পর্ব-৫

একজন প্রশ্ন করেছিল, ” ম্যাম, কারো সাথে সম্পর্ক টানা যখন গলায় হাঁসফাঁশ দড়ি হয়ে দাঁড়ায়, তখন কি সম্পর্কটা টেনে নেয়া উচিৎ? নাকি শেষ করে দেয়া উচিৎ? নাকি সমাজের দোহাই দিয়ে “বাচ্চা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে”, এটা ভেবে বাচ্চা নিয়ে নেয়া উচিৎ?”
প্রশ্নকারিনী বিদুষী, সুন্দরী, আজন্ম বিত্তশালী লালিত্যে বেড়ে ওঠা, সামাজিক মাপকাঠিতে দারুন একটি চাকরি করা একজন মানুষ۔ তার নিজ যোগ্যতার কোথাও কমতি নেই۔
আমরা ছোট থেকেই মেয়েদের তৈরী
করি ভালো রেজাল্ট, নাচ গান আবৃত্তির ছন্দে সমাজের চোখে লক্ষী করে۔ কিন্তু কিছু কিছু অভিভাবক তথাকথিত সুপাত্রে বিয়ে দিয়ে এতোই তৃপ্ত বোধ করেন যে মেয়ের প্রতিদিনের নির্যাতনের আগুনে পুড়ে যাওয়া মন, বালিশে কান্নার দাগ কিছুই দেখেন না۔ শরীরে মারের দাগ দেখা যায়, কিন্তু মনের আঘাতের চিহ্ন কি দেখানো যায়? নিজের মেয়ের কষ্টের থেকে লোকে কি বলবে সেটাই তাঁদের কাছে মুখ্য۔ কবির ভাষায় পাছে লোকে কিছু বলে۔
তার মানে কি তাঁরা নিজের মেয়েকে ভালোবসেন না ? অবশ্যই ভালোবসেন۔ বাবা মা’র থেকে সন্তানকে কেউই বেশি ভালোবাসে না! এনারাও ব্যথিত মেয়েকে রক্ষা করতে না পারবার অসহায়ত্বের কষ্টে; কিন্তু সমাজ কি বলবে এইটাই তাদের ধারণা বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত۔ মেয়ের জীবন থেকে সমাজ বড় এইটাই এ ধরণের পেরেন্টস এর limitations of thoughts. আমাদের সবারই নানা রকম লিমিটেশনস থাকবেই এটাই স্বাভাবিক۔ পারফেক্ট বলে তাই আসলেই কিছু নেই۔
কিন্তু মেয়েটির কি হবে ? যে সহে সে রহে এই মন্ত্র কত দিনের রক্ষা কবজ হবে তার ? একজন মানুষ কতক্ষন ধরে, কত দিন পর্যন্ত, কতটুকু সহ্য করবে ? প্রতি দিন মরে মরে লক্ষী মেয়ে হলে আসলে কার লাভ ?
রবীন্দ্রনাথের সেই কথাই মনে পড়ে, “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমান করিল সে মরে নাই۔ “
মেয়েটি মরে যাওয়ার পর অন্যের প্রদত্ত লক্ষী মেয়ের খেতাবে মেয়েটির বা তার সেই অসহায় বাবা মা’র আর কি আসে যায় ?
যাঁরা মানসিক নির্যাতনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ান তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔

পর্ব-৬

“ম্যাম আমার প্রথম সমস্যা হলো, অনেক অস্থিরতায় ভুগি সাথে বেশি ভয় পাই! আগে মাঝে মাঝে প্যানিক এটাক হতো, বদ্ধ জায়গায় বেশি ভয় লাগে! এগুলা ছাড়াও মেইন সমস্যা হলো ইনসেক্যুরিটি! সব কিছুতে অনেক ভয় কাজ করে! Self-confidence nearly zero!” মানুষটি পেশাজীবী, বিয়ে করেন নাই, সম্পর্কেও জড়াননি۔ কারণ ওর ‘ভিতরের আমি’ এতটাই বেশি কাতর যে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে নিজের অস্থিরতার কারণ খুঁজতে খুঁজতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ার মতই এরপরের লেয়ারে উঠে আসে প্যানিক এটাক, তারপর সেটা ট্যাকেল করতে না করতেই তার নিচে খুঁজে পায় ইনসেক্যুরিটি۔ তার নিচে ভয়, এভাবে চলতেই থাকে۔ মানুষটির মনের গহীন কুয়ায় প্রতি ধাপে ধাপে বদ্ধ জায়গার আরও কত কিছু যে লুকিয়ে আছে সে নিজেও জানে না۔ নিজেকে বুঝতে না পারার এইবোধ থেকে ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে আত্মবিশ্বাস۔ নিজেকে তুচ্ছ মনে হতে থাকে সবার থেকে۔ তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔ মানুষটি নিজেকে একটু একটু করে গুটিয়ে নিতে থাকে চার দেয়ালের মাঝে۔ তার “ভিতরের আমি” আরও কুঁকড়ে যেতে থাকে অযত্নে, অবহেলায়۔ কারণ নিজেকে নিজের মতো করে নিজে না বুঝলে বাইরের কে বুঝবে? কেউ আসবে না মনের কালকুঠুরি থেকে উদ্ধারে۔ আমরা আমাদের চারপাশের আন্তঃসম্পর্কগুলিকে যতটুকু যত্ন করি “ভিতরের আমি”কে কি আদৌ প্রতিদিন ততোটুকু যত্ন করি? “আমার আমি” কি চাই তাঁর সেই ছোট্ট ছোট্ট নির্দোষ চাওয়া পাওয়াগুলি কি মিটাই? ছেলে মাছ খায় না বলে এই অকালের বাজারে আমার মাছ পছন্দস্বত্বেও দিনের পর দিন আমি ওর পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে মাংসই করছি۔ একটু ভেবে বলুনতো নিজের ভালো লাগার কোন কাজটা শেষ কবে করেছেন ? আগে না করলে এখন শুরু করতে দোষ কি ? সেলফ কেয়ার মানে কিন্তু সেল্ফিশ না۔ অন্যকে যত্ন করার পাশাপাশি যাঁরা নিজের “ভিতরের আমি”র যত্ন করেন তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔

পর্ব-৭

” জানেন আমার নিজের মা বলে আমারই দোষ, আমি ওকে বেঁধে রাখতে পারি নাই۔ মেয়েদের বেঁধে রাখতে পারাটা নাকি শিখতে হয়۔ আমার সেই শিক্ষা নাই۔”

মেয়েটি একটা প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে۔ যার আন্তর্জাতিক রাঙ্কিং ১০০’র মধ্যে۔

কলেজ থেকে প্রেম۔ দুজনে দুজনার চোখ দেখলেই মনের কথা বুঝে এমন গাঢ় সম্পর্ক۔ তারপর দেশে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে মেয়েটা পাড়ি জমালো সাতসমুদ্র তেরো নদী পাড়ে আরও পড়াশুনা করতে, প্ল্যান ছিল মেয়েটি ছেলেটিকেও নিয়ে যাবে۔ ইতিমধ্যে ছেলেটি দেশেই টুকটাক টিউশনি করার সাথে সাথে বেছে নিয়েছিল বিসিএসের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন সাধনা۔ অবশেষে সেই মহার্ঘ্য চাকরি নামের সোনার হরিণ ছেলেটির হাতে আসলো ঠিকই কিন্তু মেয়েটি এবার সত্যি সত্যিই ছেলেটার মনোভূমিতে আক্ষরিক অর্থেই পররাষ্ট্র হয়ে গেলো۔ ছেলেটি সম্পর্কটি ভেঙে দিলো۔

তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔

সম্পর্ক হয় 2 জন মানুষের মধ্যে۔ মেয়েটি সেই পুরানো মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ছেলেটি সেই মোড় ছেড়ে অন্য রাস্তায় পা বাড়িয়েছে۔ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন চাবি অন্যজন তালার ভূমিকা পালন করে۔ খাপে খাপে না বসলে মাধুর্যের লক খুলবে কেন?

প্রতিটি সম্পর্ক হচ্ছে ব্যাংকের ট্রান্সেকশনের মতো۔ একজন শুধু দেবে অন্যজন তার বিনিময়ে যদি শুধু নিতেই থাকে তবে এখনই সতর্ক হোন۔ সঙ্গী হাটু পানিতে নামলে আপনি তার জন্য গলা পানিতে নামুন কেউ নিষেধ করছে না۔ কিন্তু একটু খেয়াল করুন তো কোন ইস্যু নিয়ে কখনো কি একবারের জন্য হলেও সে আপনার জন্য গলা পানিতে নেমেছিল?

মানুষের দিনে দিনে জামার মাপ যেমন বদলায় তেমন সম্পর্কের চাহিদাও বদলায়۔ সেই পরিবর্তিত চাহিদা মেটাতে যদি সঙ্গী ছুটে যায় অন্য মোড়ে তার একক সম্পূর্ণ দায়ভার কি একান্তই আমার? অব্যশই না۔ কারণ সম্পর্ক হলো হ্যান্ডশেকের মতো আমি হাত বাড়ালাম আর সে বাড়ালো না, তাইলে তো হ্যান্ডশেক হলো না۔ একটা সম্পর্ককে রক্ষা করবার দায়িত্ব উভয়ের۔ একজনের উড়ু উড়ু মন অন্যজন বেঁধে রাখবার অক্লান্ত চেষ্টায় প্রতিদিন অদৃশ্য যুদ্ধ করছে এই মাইন্ড সেট পাল্টানোর সময় এসেছে۔

সঙ্গী যদি ছুটে যায় সসম্মানে তাকে মুক্তি দেয়াই ভালো۔ কারণ জল ঘোলা করে সম্পর্ক জোরজবরদস্তি টিকিয়ে রাখলেও সেই ঘোলা জলে কারোরই সম্পর্কের তৃষ্ণার পানির চাহিদা মিটাবে না۔ তাই ওই পুরাতন কথা, ” পাখিটিকে ছেড়ে দাও সে যদি ফিরে আসে পাখিটি তোমার۔” এটাতে ২টা লাভ প্রথমত পাখিও বুঝলো অন্য ক্ষেতের দানাপানি তার সহ্য হয়না۔ আর দ্বিতীয়ত পাখি যদি চলেই যায় আপনিও বুঝলেন এই পাখি না আপনার ছিলই না۔ তাই গেছে আপদ বিদায় হয়েছে۔

পর্ব-৮

ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী 2 জনই চাকরি করতেন۔ এখন জুন থেকে কারোর চাকরি নেই۔ মেয়ে পড়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে۔ ছেলেটা কলেজে۔ ছোটটা স্কুলে۔

এর মধ্যে ফ্লাট এর লোন মাসে মাসে শোধ করতে হয়۔ থোক টাকা বেরিয়ে গেছে ফ্ল্যাটের ডাউন পেমেন্টে۔ ভদ্রমহিলা বুদ্ধিমতী۔ পরামর্শ দিচ্ছেন সীমান্তবর্তী মফস্বল শহরে ভদ্রলোকের পৈতৃক ভিটেবাড়িতে কিছুদিন থাকতে۔ কারণ এতে অন্তত বাড়ীভাড়াটা বাঁচবে۔ আর বাচ্চাদের তো অনলাইনে ক্লাস۔ তাই যেখানেই থাকুক কোনো সমস্যা নেই۔

কিন্তু ভদ্রলোক এটা মেনে নিতে পারছেন না۔ বলছেন, ” আপা নিজেকে অক্ষম মনে হচ্ছে, ওটা তো নামেই শহর আদতে গ্রাম۔ যেইখানে আমার বাবাই আমাকে রাখেন নাই ওইখানে আমার আজীবন ঢাকায় জন্মকর্ম বাচ্চাদের কিভাবে নিয়ে ফেলবো ? আপনার ভাবীর সবাই ঢাকায় সেটল ওদের কি ভাবে মুখ দেখাবো, গ্রামের নিজের পরিচিতদের কি মুখ দেখাবো, লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে?”

তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔

কথায় আছে “A penny saved a penny earned.” তাই এখন জমানোর স্বভাব গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন۔

এই বৈশ্বিক মহামারীতে কিছু কিনতে হলে হুট করে না কিনে একটু ভেবে দেখি ওটা ছাড়া বিকল্প কি কি অপসন আছে আমার চলার মতো۔ খুব দরকার না হলে খরচ না করি۔

কারণ, ” সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সমীক্ষা বলছে, লকডাউন ও সাধারন ছুটির ৬৬ দিনে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে। হত দরিদ্রদের তালিকায় নতুন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ যোগ হয়েছে। এদিকে ব্র্যাকও বলছে, ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে।” ( তথ্য সূত্র সংযুক্ত )

তাই সাময়িক যদি আমার খরচ কমাতে হয়, ছোট বাসায় শিফট করি, গিফট দিতে না পারি এতে লজ্জার কিছু নেই۔ এই সময়ের এটাই ট্রেন্ড۔

একটু অপেক্ষা করি۔ এই অতিমারী কমবে۔ আবার নতুন কাজের জায়গা তৈরী হবে۔ ততদিন পর্যন্ত শুধু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখি, সুস্থ রাখি۔ এরপরে আবার একদিন হুলুস্থূল পার্টি হবে۔ সেই বিশ্বাস মনে রাখি۔ আর সেই আমোদ আহ্ললাদে আমাকে দাওয়াত দিতে ভুলবেন না কিন্তু-

পর্ব-৯

ব্রিটিশ বাংলাদেশী চিকিৎসক Dr. Farzana Hussain-র ছবি লন্ডনের সুবিখ্যাত মোড় পিকাডেলিতে বিলবোর্ডে۔ তিনি GP of the year নির্বাচিত হয়েছেন UKতে۔ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন۔ স্যালুট۔

কিন্তু, এই ছবি দেখে কারো মনে হতে পারে এই হিজাবি মহিলা বাজারের মোড়ে সবাইকে মুখ দেখিয়ে নিজে দোজখে যাবে!

কিংবা,

ওই সমাজের ব্যাটাগুলি কই? কেন মহিলার ছবিই দিতে হবে? ইত্যাদি, ইত্যাদি!

এমন ভাবনা আসলে নিজের মাইন্ড সেট আপের দিকে একটু খেয়াল করতে বলবো۔

কারণ এখানে যখন একজন মানুষের প্রশংসা করা হচ্ছে তাঁর সেবাকর্মের জন্য۔ আপনি সেখানে নারীমাংস খুঁজছেন নাতো? আপনি কি এভাবেই সবখানে মেয়েদের খেয়াল করেন? আপনার মাইন্ড সেটআপ কি বলে?

ভালো কাজের নির্দেশ নারীপুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্যই প্রযোজ্য۔ তাহলে কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের এই বিভাজন কি আপনার মাইন্ড সেটআপের লিমিটেশন? তাই যদি হয় আপনি কি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকার ক্লাস, বাড়ির বুয়ার রান্না, কিংবা গার্মেন্টসের নারী কর্মীর সেলাই করা কাপড়পড়া বর্জন করেছেন?

স্রষ্টার প্রার্থনা শুরু হয় প্রশংসা দিয়ে۔ সৃষ্টিকর্তা তাঁর রঙে রঞ্জিত হতে বলেছেন কারণ তিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু, উদার, পূর্ণাঙ্গ۔ ক্ষুদ্রতা স্রষ্টার নেই, ক্ষুদ্রতা আছে মানুষের۔ চিন্তার লিমিটেশন স্রষ্টার নেই۔ limitation of thoughts হলো মানুষের মনোজগতের ভাবনার জায়গার একান্ত ব্যাক্তিগত সীমাবদ্ধতা۔

ধর্মবিশ্বাস বা অবিশ্বাস প্রতিটি মানুষের একান্ত অধিকার۔ সেখানে জবরদস্তি চলে না۔ ধর্মান্ধতার কুৎসিত কূপমণ্ডূকতার যূপকাষ্ঠে যুগে যুগে বলি হয়েছে মানবতা۔ ঠিক যেমন এই ছবিটি দেখে কেউ প্রশংসামুখর কেউ পান নারী মাংসের ঘ্রান۔

তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔

যারা ঘ্রানজীবি তারা নিজেরাও কিন্তু ভালো থাকে না۔ সব কিছুতে এতো এতো খুঁত ধরতে ধরতে নিজেরাও যন্ত্রনায় ভোগে নিখুঁত কেন হচ্ছে না সেই ভাবনার লিমিটেশনে۔ নিজে খিটখিট করেন কষ্ট পান আর আশেপাশের মানুষকেও অতিষ্ঠ করেন۔

রবীন্দ্রনাথের একটা সুন্দর কথা আছে, ” মন না রাঙায়ে কি ভুল করিলে কাপড় রাঙালে যোগী ۔”

স্পিরিচুয়ালিটি অনুভবের মুগ্ধতা۔

যাঁরা মানুষকে সম্মানের সাথে তাঁর কাজের জন্য মূল্যায়ন করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা

 

পর্ব-১০

বিয়ে হয়েছে বছর খানেক۔ প্রেমের বিয়ে۔ আলাদা বাসা নিয়ে টোনাটুনি সংসার۔ দুজনেই নিজ পরিবারে খুব আদরের۔ এই আদরের নামেই বিয়ের পর উভয় পরিবারের খবরদারি শুরু হল۔ প্রথম প্রথম সেটা যত্ন মনে হলেও ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠলো উভয়ের কাছেই۔ জয়েন্ট ফ্যামিলিতে না থাকা স্বত্বেও দুজনের মধ্যে শুরু হল “আমার বাড়ী তোমার বাড়ী” নিয়ে টানাপোড়ন۔ এর মধ্যে বাচ্চা কেন নিচ্ছে না সেই দুশ্চিন্তায় পরিবারের লোকজনের তো বটেই এমনকি পাড়ার মাসতুতো নানার পিসতুতো খালার পোষা বিড়ালটিও ঘুম হচ্ছে না বিধায় উপদেশের বন্যা বইয়ে দিতে থাকলো۔ একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়গুলি আর একান্ত থাকলো না ; সেটা ঝড় তুললো চা এর টেবিলে, পারিবারিক দাওয়াতে বা ফোনে আলোচনার বিষয়বস্তুতে۔

মেয়েটি বলছিলো, ” ধরুন, কেউ যখন ব্যক্তিগত সম্পর্গুলোয় টানাপোড়েনে থাকে তখন অন্যরা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেটাকে জাজ করে বা উপদেশ দেয়। ওর বাড়ীর হলে ও বলে, ‘এতো রিএক্ট করবার কি আছে ?’ আমার বাড়ী হলে আমি বলি, ‘এমন করার কী আছে, এটাকে স্বাভাবিকভাবে নাও’।মাঝখান থেকে আমাদের দূরত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে۔ “

এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔

সব সম্পর্কেরই নিজস্ব প্যাটার্ন থাকে। আস্তে আস্তে সেটা দানা বাধে۔ আপনার জুতোর মাপ আর যাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে তার জুতোর মাপ এক না۔ তাই উপদেশ দিতে গেলে বা সেই সস্পর্কর সমস্যাগুলোর সমাধানে কাউকে সাজেশন দিতে গেলে ওই প্যাটার্ন অনুযায়ী দেয়া অন্যের পক্ষে সম্ভব না। গায়ে পড়ে উপদেশ দেওয়া হয়তো আপনার মনে হচ্ছে মহৎ কাজ কিন্তু বিশ্বাস করুন যাকে দিচ্ছেন তাঁর জন্য দারুন বিরক্তিকর۔ হয়তো আপনি বড় বলে সে কিছু বলতে পারছে না۔

2 জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সংসার করছে۔ তাদের সমস্যা তাদের সমাধান করতে দিন۔ তাদের বুদ্ধিমত্তায় আস্থা রাখুন۔

অন্যের সম্পর্কে যারা পিনোকিয়োর মতো লম্বা নাক গলিয়ে উপদেশের বন্যা বইয়ে দেয় না তাদের জন্য অনেক শ্রদ্ধা۔