কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
পর্ব-১১
মেয়েটির পড়াশুনার দুর্দান্ত আগ্রহ ۔ মধ্যবিত্ত গন্ডিতে বেড়ে ওঠায় ছোট বেলা থেকেই নানা রকম নারীশিক্ষা বিরোধী প্রথার বৃত্তবন্দি কথা শুনেছে۔ শৈশবে, কৈশোরে, তারুণ্যে সেই সব একপেশে কথা মেয়েটির মনকে রক্তাক্ত করেছে বহুবার۔ অসহায়ত্বের বেদনায়, কিছু বলতে না পারার অক্ষমতার ক্রোধে নিজেই জর্জিরিত হয়েছে۔
মেয়েটি বলে, ” এখন এসব শুনতে শুনতে কান পচেঁ গেছে কিন্তু আব্বু আম্মুকে নিয়েই পড়ি বিপদে। আদি সমাজ প্রথায় অভ্যস্ত তারা, আমার কিছু বলা মানে হলো আমি অবাধ্য সন্তান। সাথে প্রতিবেশীর অতি প্রয়োজনীয় পরামর্শ :
১. মেয়ে মানুষ সেই তো বিয়ে করে সংসার করতে হবে কি দরকার ডাক্তারি পড়ানোর??
২. বেসরকারি মেডিকেলের ডাক্তারি সাটির্ফিকেট এর দাম নাই, শুধু শুধু এত টাকা খরচ করতেছেন।
৩. পাশ করতে পারবেনা,বিয়ে দিয়ে দেন। এত চিন্তা করে কি করবেন?
৪. BCS দেয়নি? ছি ছি। সব BCS ডাক্তার নিয়ে নিলো এবার,পরে আর ডাক্তার নিবেনা।
৫. বিয়ে হয়ে গেল এখনও বাচ্চা নেয়না কেন? নাকি কোন সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে ডাক্তার দেখাইতে বলেন।
৬. সিজারিয়ান করতে পারে আপনার মেয়ে? না পারলে কিসের ডাক্তারি পড়লো?
৭. এখনও নিজের কোন chamber নাই! কি করে তাইলে?! “
তারপর সেই একই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
মেয়েটির সাথে ক্রমাগত দূরত্ব বারে তার মা বাবার۔ যেই মানুষ দুটি ছিল আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের একমাত্র অবলম্বন সেই ছায়া হারিয়ে যায়۔ মেয়েটি জীবনের ধূসর মরুভূমিতে۔ এর মাশুল দেয় মেয়েটা হয়তো ভুল সম্পর্কে আশ্রয় খুঁজে বা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশার সাগরে ডুবে۔
মা বাবা এতো দিন ধরে এতো কিছু করবার পরেও কেন এভাবে হাত ছেড়ে দেয়? এটা পেরেন্টস এর limitations of thoughts. সমাজ যেভাবে ভাবতে শিখিয়েছে ওনারা সেভাবেই ভাবেন তার মানে কিন্তু এই না যে ওনারা সন্তানকে কম ভালোবসেন۔ তার মানে এই যে এভাবে ভাবা ছাড়াও যে অন্য ভাবে ভাবা যায় সেই বিকল্প ভাবনার জায়গাটাই পেরেন্টস কখনো তৈরী হতে দেয়া হয় নাই۔ এখানে বলে রাখা ভালো সব পেরেন্টস কিন্তু এমন না۔ এখানে শুধু রক্ষণশীল মানসিকতাসম্পন্ন পেরেন্টস এর কথাই বলছি۔
কিছু মানুষের অভ্যেসই থাকে অন্যের বাড়িতে ফুচকি মারা۔ নিজের খুঁত লুকিয়ে অন্যের দিকে আঙ্গুল তাক করতে এরা আজীবন পারদর্শী۔ এরা কখনো বদলাবে না۔ কাজেই এদের কথার রেসপন্স করে নিজের সময় ও এনার্জি দুটাই নষ্ট করবার কোন প্রয়োজন নাই۔ নিজের চারপাশে অদৃশ্য মনস্তাত্বিক বাউন্ডারি দিন যাতে এই সব ছাগল আপনার বৃত্তে ঢুকতে না পারে۔ বাবামাকে বলুন, ” I don’t care কে কি বললো۔ আমি শুধু তোমাকে কেয়ার করি, কারণ তুমি সব সময় আমাকে ভালো রাখবার জন্য কষ্ট করেছো, আমি দিনের পর দিন ফীল করেছি তোমার সেই কষ্ট, এতদিন সেটা বলে ওঠা হয় নাই۔ ওরাতো আমার জন্য কিছু করে নাই۔ আমাকে উন্নত জীবন দেবার জন্য তোমার করা এই জীবন যুদ্ধে কখনোই বাইরের কেউ সামান্যতম সাহায্য করে নাই, তাই বাইরের মানুষ কি বললো কি ভাবলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না۔ ওরা আমার out of syllabus. কিন্তু তুমি কষ্ট পেলে আমি কষ্ট পাই۔ কেন আমরা আমাদের দুই জনের মাঝে এই আগাছা খাওয়া ছাগল গুলিকে ঢুকতে দেব ?”
মা বাবা কে জড়িয়ে ধরে রাখুন অন্তত ৩০ সেকেন্ড দেখুন কি ম্যাজিক্যাল চেঞ্জ হয়۔ ফলাফল জানাতে ভুলবেন না আমাকে۔
যাঁরা অন্যকে গায়ে পড়ে উপদেশ দেন না তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১২
শুভ্র আর দীপা তিন বছর সম্পর্কের পর বছরখানেক হলো বিয়ে করেছে। ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে নিজেদের মতো। দুজনেই ভীষণ রকম অসাম্প্রদায়িক ও শিল্পপ্রেমী বলে সংসারে সাধারণ গোঁড়ামি নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুভ্রকে কাজ করার সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই নারী সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়। কাজের বাইরেও তার কিছু সুসম্পর্ক রয়েছে। বিয়ের আগে শুভ্র ও দীপার মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা অসুবিধা না থাকলেও বিয়ের পর একসঙ্গে থাকার কারণে ছোটখাট অনেক ঘটনাই চোখে পড়ছে দীপার। যা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে । যেমন,
* বাড়ি ফেরার পর শুভ্র অধিকাংশ সময়ই ল্যাপটপ / ফোনে সোস্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায়।
* দীপাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে না।
* ইদানিং কথাবার্তাও কম হয়।
* গভীর রাত অব্দি শুভ্র লিভিং রুম বা বারান্দায় ফোনে কথা বলে।
* রাত চারটা পাঁচটার সময় ঘুমাতে আসে।
* সকালে বেরিয়ে পড়ে।
* পরের দিন আবার একই নিয়ম।
শুভ্রর অমনোযোগিতার কারণ খুঁজতে দীপা কয়েকবার শুভ্রর ফোন চেক করে। যেখানে সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন জনকে করা নানান মেসেজ ভেঙে দিয়েছে দীপার মন। কারো সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে শুভ্র, কখনওবা ইনবক্সে কোনো নারীর ছবিতে ঝাঁঝালো মন্তব্য করেছে, আবার কখনো নানান তরিকায় ছবি তুলে ইনবক্স করার কথা বলেছে শুভ্র। দীপা ক্ষত বিক্ষত হয়ে একদিন শুভ্রর সঙ্গে আলাপ করতে বসলো। স্বাভাবিকভাবেই সব অস্বীকার করলো শুভ্র।
দীপা বিছানা আলাদা করে নিল। এরপর থেকে দীপা খেয়াল করলো শুভ্র তার ইনবক্স থেকে সব নারীদের মেসেজ ডিলেট করে ফেলে। শুভ্র স্নানে গেলে মাঝেমধ্যে দীপা তার ফোন চেক করতো। সেখানেই বিষয়গুলো ধরা পড়তো। এভাবে চেক করার বিষয়ে নিজের কাছেই খারাপ লাগত দীপার। বিয়ের আগে কিন্তু শুভ্র অনেক পজেসিভ ছিল। দীপার ফোন চেক করত, দীপা চারুকলার স্টুডেন্ট ছিল, বন্ধুবান্ধবও কম ছিল না। শুভ্রর পজেসিভনেসের কারণে দীপা ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমায়, পোশাকে পরিবর্তণ আনে, নাচও ছাড়ে। কিন্তু শুভ্র কিছুই ছাড়েনি। বলে, “আমি আমার প্যাশন ছাড়ব না।” তর্কাতর্কিতে শুভ্র দীপার গায়ে হাতও তোলে। দীপা পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করলে তারা উল্টো দীপাকে বোঝায়। বলে, “শুভ্রর পেশাটাই এমন যে উদারভাবে কাজ করতে হবে।” এটিকে ইতিবাচকভাবে নেয়ার পরামর্শ দেয় দীপাকে। বলে সন্দেহ কমাতে। লিবারেল হতে শিখতে অনুরোধ করা হয় দীপাকে। কিন্তু দীপা যখন নিজের কম্প্রমাইজের কথা তোলে তখন ফ্যামিলি ফ্রেন্ডরা বলেন, “এতই যখন সমস্যা তখন বিয়ে করলে কেন? যেটা গেছে তা গেছে। থাকতে না পারলে ডিভোর্স দাও নয়ত লিবারেল হও।” এরা নিজেদের উদারনৈতিক মনোভাবের উদাহরণ দেয়।
দীপা একে একে সব ছেড়েছে। প্রথমে বন্ধু, পরে প্যাশন তারপর শুভ্রর সঙ্গে একান্তে সুন্দর সময় কাটানোর আশা। এতো সবকিছুর পরও দীপা শুভ্রকে ছাড়তে চায় না। তার সঙ্গেই সুন্দর সংসার করতে চায় যেভাবে অন্যান্য সুখী দম্পতিরা করে।
দীপা আমাকে প্রশ্ন করে, “এর সমাধান কী?”
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
কাউন্সিলর কিন্তু সমাধান বলে দেয় না۔ শুধু যিনি এসেছেন তাঁকে তাঁর পরিস্থিতি অনুযায়ী যে যে অপশনগুলি আছে সেইগুলি অ্যাডাল্ট মাটিউরিটি নিয়ে ভাবতে সহায়তা করে۔ সিদ্ধান্ত ক্লায়েন্টের নিজের۔ কারণ তার অবস্থা তার থেকে কেউ ভালো বুঝবে না۔
এখন দীপার বিবেচ্য কি কি ?
* এই সম্পর্ক থেকে দীপা কি চায় ৫/১০/২০ বছর পরে ?
* কেউ কাউকে বদলাতে পারে না যদি না সে নিজে নিজেকে বদলাতে চায়, দীপা কি ছেলেটাকে বদলাতে চায় ?
* আরও কতদিন টাইম, এনার্জি খরচের এফোর্ট দীপা এই সম্পর্ককে দিতে চায়? কিভাবে দিতে চায়? কোন চিন্তা থেকে দিতে চায়? দিলে কি হবে ?
* দীপা কি শুভ্রকে রেস্পেক্ট করে? ০- ১০ স্কেলে কতটুকু রেস্পেক্ট করে? কতটুকু ভালোবসে? এই রেস্পেক্ট কত দিন ধরে রাখতে পারবে?
* ওদের সন্তান আসলে এই পরিস্থিতির কি পরিবর্তন আসবে?
* দীপা কি couple counseling এর কথা ভেবেছে ? শুভ্র কি এটাতে রাজি হবে ?
* সম্পর্ক ভাঙলে দীপা কি সেই জের ধরে তার পরবর্তী সব আসা সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি সমাধান করতে সাহস রাখে?
* দীপা কি নিজেকে দুর্বল ভাবে ? ভাবলে কোন জিনিষটা সে পারে না ?
এই প্রশ্নগুলির জবাব কিন্তু দীপা ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না۔ কাজেই নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনতে হবে۔
সম্পর্কের বুনন হলো পারস্পরিক সন্মানবোধ ও বিশ্বাস۔ মতের অমিল থাকা স্বত্বেও যাঁরা সঙ্গীকে সন্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১৩
মেয়েটি সিঙ্গেল মাদার۔ ভালো চাকরি করে۔ডিভোর্স হয়েছে 6 বছর۔ একটাই বাচ্চা পড়ে জুনিয়র সেকশনে, বাচ্চাটা মা’র সাথেই থাকে۔ বছরকয়েক আগে মেয়েটার অফিসে ট্রান্সফার হয়ে আসে ছেলেটা۔ তারও ডিভোর্স হয়ে যায় অন্য কোন কারণে۔ দিন যায়, আস্তে আস্তে ঋতুপরিবর্তনের সাথে সাথে ছেলেটি ও মেয়েটির সম্পর্কের রসায়নও গাঢ় হয়۔ মেয়েটির বিপদে আপদে সব সময় পাশে থাকতে থাকতে কেমন এক অদ্ভুত নির্ভরতার আশ্বাস ছেলেটি মেয়েটিকে দিতে থাকে۔ একসময় যখন মেয়েটি বিয়ের কথা বলে ছেলেটি টালবাহানা করে পেছাতে থাকে۔
মেয়েটি বলে, ” আমিতো জড়াতে চাইনি ওই তো আমাকে আগে প্রপোস করে, দিনের পর দিন আমার পিছে ঘুরে ঘুরে আমাকে রাজি করিয়েছে۔ এবার যখন আমি সর্বস্ব দিয়েছি তাহলে এখন কেন মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে ?”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
নিজেকে উজাড় করে কাউকে দেবার আগে খেয়াল করেছেন তো পাত্রটির ধারণ ক্ষমতা কতটুকু ? আপনি ১০ লিটার ভালোবাসা দেবেন আর সে যদি 1 লিটারেই উপচে পরে তাইলে বাকি 9 লিটার ভালোবাসা ধারণ করবার কোন ক্ষমতাই তার নেই۔ তবে কেন আপনি একজন অক্ষমের পিছে আপনার টাইম, এনার্জি, টাকা ব্যয় করবেন? তাঁকে তার মাপের 1 লিটারের কাউকে খুঁজে নিতে দিন না۔ আপনি সরে আসুন۔ বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা নাই বা দিলেন۔ জীবনের পথ অনেক লম্বা۔ কে জানে কোন মোড়ে ১০ লিটার নিতে পারে এমন কেউ সেই ভালোবাসা আবেগ নিয়ে আপনারই প্রতীক্ষায় আছে? জীবন রূপকথার থেকেও আজব۔
যাঁরা অন্যের ভালোবাসা কে সন্মান করতে পারেন তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১৪
প্রশ্নটি ছিল, “ধরেন,ঘরের পরিবেশ পরিবর্তন হবেনা তখন কি কেবল একতরফা সহ্যইতো করতে হবে?”
এমন সহ্যের যূপকাষ্ঠে কত মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে অদৃশ্যভাবে কোরবানি হচ্ছে তার কোন ইয়াত্তা নেই۔ “যে সহে সে রহে” এই বীজ মন্ত্র জপে জপে কাহাতক চলা যায়? কতদিন চলা যায়? কেনই বা এতো বেদনার ভার নিতে হবে যেটা জীবনকে বোঝায় পরিণত করে ?
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
You can’t change others. You only can change yourself .
১. ঘরের পরিবেশ পরিবর্তন করতে অপর জনও কিন্তু কান্ট্রিবিউট করে ধরুন, সেই অপর জন হলেন আপনার জীবনসঙ্গী বা শ্বশুর শাশুড়ি۔
২. এখন উনি যদি নিজে থেকে বদলাতে না চান তাইলে আপনি তো দূরের কথা কারোই সাধ্য নেই তাকে বদলানোর۔
৩. তাই অযথা এই বৃথা চেষ্টায় নিজের টাইম, এনার্জি, মানি (ক্ষেত্র বিশেষে) নষ্ট করবার দরকার নেই۔
৪. আপনি যেই আঘাতটা পাচ্ছেন সেটা কিভাবে প্রসেস করবেন নিজেকে ভালো রাখতে সেটাই ভাবুন۔
৫.প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন এই abusive relationship এ থাকবেন কিনা ?
৬. সিদ্ধান্ত যদি “থাকবো না” হয় তবে নিজেকে ধীরে ধীরে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবার যোগ্য করে তুলুন۔
৭. যত দিন সময় লাগছে নিজেকে তৈরী করতে প্রয়োজনে ততো দিন এই সম্পর্কে থাকবার সিদ্ধান্ত নিন ( যদি দূরে যেয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার ক্যাপাসিটি না থাকে )۔
৮. নিজেকে বলুন আমি এই এই স্পেসিফিক কারণে এই রিলেশনশিপকে abusive ভাবছি এবং এর থেকে বের হতে চাই۔ তাই নিজেকে তৈরী করছি۔ যেই দিন তৈরী হবো আমি বের হয়ে যাবো, রূপকথার কেউ বের করে নিয়ে যাবে না আমাকে۔ আমিই আমাকে উদ্ধার করবো۔
৯. একটা ডেডলাইন মাথায় ঠিক করুন যে এতো দিন পর আমি এই এই স্টেপগুলি নেবো নিজেকে বের করে আনতে۔
১০. তাইলে দেখবেন আপনি ভিক্টিম পজিশন থেকে সরে গেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন বলে সেই বুক খামচে ধরা অসহ্য কষ্ট কম হবে۔ কারণ এখন আপনার সামনে একটা ডেডলাইন আছে, অনির্দিষ্ট কাল আপনি সহ্য করবেন না আপনি জানেন۔
১১. তাই ডিসিশন নেয়াটা জরুরি, যে আমি কি চাই তার জন্য কি কি করবো۔ আমার স্টেপ বাই স্টেপ প্ল্যান কি ? প্রথম ধাপে কি করবো , কতদিন ধরে করবো ? এরপর দ্বিতীয় ধাপে কি করবো, এভাবে শেষ পর্যন্ত কি করবো ? পুরো প্লানটা মনের চোখে দেখুন۔
১২۔ আমরা অন্যকে বদলাতে পারি না শুধু নিজে নিজেকে ছাড়া۔ তাই আত্মজয়ের চেষ্টা সর্বোচ্চ জিহাদ۔ সক্রেটিস বলেছেন, “নিজেকে জানো”۔ আমি কি চাই , আমার ভেতরের আমি কি চায় সেটা জানাটাই মুখ্য۔
যারা অন্যকে abusive relationship এর victim করেন না, মতের অমিল থাকা স্বত্বেও অন্যের আমিত্বকে সন্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১৫
ছোটবেলাকার প্রেম, তারপর বিয়ে۔ সামাজিক আড্ডায়, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় সুখী পরিবার۔ দুজনেই বয়স ৪০ পেরিয়েছে۔ এর মধ্যেই একদিন আবিষ্কৃত হয় একজনের মেসেন্জারে অন্যরকম মেসেজ۔ যিনি দেখলেন তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে চিল্লাচিল্লি না করে জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে খোলাখুলি বিষয়টা জানতে ও বুঝতে চাইলেন۔ পার্টনার একে মুহূর্তের অসর্তকতা বলে তাদের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের দাবীতে বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বললেন۔ অন্যজন উদারচিত্তে এই সাময়িক অপ্রাসঙ্গিক পদস্থলন মেনে নিলেন۔
বাইরের কেউ কিছুই বুঝলো না۔
এর কিছুদিন পর আবার মেসেজ এলো۔ এবারও পার্টনার বাথরুমে۔ মানুষটি আমাকে বললেন, ” আমি কি প্রথমবার সুযোগ দিয়েছিলাম বলেই ও দ্বিতীয়বার একই ভুলটি করলো ?”
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
Cheating is a choice, not a mistake. এখন মানুষের অভিধানে চিটিং এর ডেফিনেশন কি ?
এনার সাথে যা হয়েছে সেটা ওনার সঙ্গীর সাথে হলে উনি কি মেনে নিতে পারবেন?
যারা অন্যকে সন্মান করে তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১৬
আজকের মানুষটি মধ্যবিত্ত জীবনের ঘোরটোপে আজন্ম আবর্তিত۔ ছোট ছোট আশা আনন্দেই জীবনের সুখ খুঁজে নিতে জানেন۔ তিলে তিলে পাওয়া না পাওয়ার খেরোখাতার হিসেববন্দি জীবনে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন নিজেকে۔ আদর্শ জীবন সঙ্গী, সন্তান, সামাজিক সম্মানের পালক সবই তার মুকুটে۔
এই মানুষটিই আমাকে বললেন, “আমাদের স্বামী স্ত্রীর আন্তসম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের উপিস্থিতি নেই কিন্তু সব কিছুতেই বড় একঘেয়ে লাগে আজকাল۔ আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয় না۔ শারীরিক সংযোগও আছে কিন্তু মনের সংযোগটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে۔”
এর পর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
আমাদের আন্তসম্পর্কগুলির প্রতিনিয়ত যত্ন প্রয়োজন۔ ঠিক যেমন আমরা টবের গাছে নিয়ম মেনে পানি দেই তেমন۔ শারীরিক ইন্টিমেসি থাকলেই যে মানসিক ইন্টিমেসি থাকবে এটা কিন্তু একান্তই প্রচলিত ভুল ভাবনা۔ পাশাপাশি শুয়েও দুটি মানুষ লক্ষ যোজন দূরে দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী হতে পারেন۔
মনস্তাত্বিক ইন্টিমেসি মানে দু’জনের মধ্যে কোন সিক্রেট মেসেজ থাকবে না۔ তাদের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও উভয়েই খোলাখুলি নিজের দুঃখ, কষ্ট, রাগ, আনন্দগুলি একে অন্যকে বলতে পারবার বন্ধুত্বের একটা ওপেন স্পেস তৈরী করবেন۔ এটা কিন্তু একদিনে হবে না۔ তাই বলেছি গাছে পানি দেয়ার মতো প্রতিদিনের সম্পর্কের যত্ন প্রয়োজন হয়۔ যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেগলেক্টেড۔ এই পারস্পরিক ওপেন স্পেসের নৈকট্য যদি অন্তঃসম্পর্কে না থাকে তবে সেই সম্পর্কে মানসিক ইন্টিমেসি নেই۔ ইন্টিমেসিতে প্রত্যেক পার্টনার নিজের ইমোশনাল রেসপনসিবিলিটি নিয়েই স্বতঃস্ফূর্ত অকপটে সঙ্গীকে বলতে পারে যে, “হ্যাঁ আমি রেগে গেছি/দুঃখ পাচ্ছি/ভয় পাচ্ছি/খুশি হচ্ছি۔”
ইন্টিমেসি থাকলে দুজনের চাহিদা না মিললেও কেউ কাউকে তার ইচ্ছাগুলির জন্যে অসম্মান করে না۔ এখানে উভয়েই পারস্পরিক যত্ন নেয়۔ নিজেদের সামনে সঙ্গীকে প্রকৃত চেহারা দেখাতে ভয় পায় না۔ মুখোশ পরে না۔ নিজের ঘাটতি খামতিতে লজ্জা পায় না۔
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হানিমুন পিরিয়ডের উন্মাতাল আবেগ কাটতে কাটতে ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে আমরা সহবাস করি কিন্তু সহ বাস (একত্রে বসবাস করি না )۔ ফলে আমরা দিনে দিনে মানসিক অবসাদ ক্লান্তি একঘেমিতে আটকে যাই۔ সেই গানটির মতো ,
“তোমাকে বুঝি না, প্রিয়
বোঝো না তুমি আমায়
দুরত্ব বাড়ে, যোগাযোগ নিভে যায়
তোমাকে জানি না, প্রিয়
জানো না তুমি আমায়
শীতের বেড়াল খেলে ঘাসের ছায়ায়
তোমাকে ডাকি না, প্রিয়
ডাকো না তুমি আমায়
জলপ্রপাত মাতে রূপোর মায়ায়”
এখন প্রশ্ন হল এই ইন্টিমেসি বাড়াবার উপায় কি? সহজ উপায় হল আপনার সঙ্গীর সদগুণের অকুন্ঠ প্রশংসা করুন۔ মনে রাখবেন এটা কিন্তু তেল মারা না۔
তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হল কেন প্রশংসা করবেন? কারণ এটাতে আপনার সঙ্গী ( নারীপুরুষ নির্বিশেষে ) নিজেকে গ্রহনযোগ্য ফীল করবে۔ আর বেলাশেষে আমার ভালো ফিলিংগুলিই আমার জীবনের পজিটিভ চালিকা শক্তি۔
যারা পার্টনারকে কোন সেন্সরশিপ ছাড়াই নিজের মনের অনুভূতিগুলি বলবার সন্মানজনক সুযোগ দেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা۔
পর্ব-১৭
একই কাজ নিজের মেয়ের জন্য যেটা ঠিক ছেলেবৌ করলে সেটাই দোষ۔ মেয়ের জামাই একটু মুচকি হেসে তাকালেও লক্ষী ছেলে আর ছেলের বউ যতই যাই করুক তাবিজ করে ছেলেটাকে বশ করেছে۔ মেয়ের জামাই আসলে মাছের মাথা, ছেলের বউ এর পাতে লেজও জোটে না۔ মেয়ে চাকরি করলে সাবাসী আর ছেলের বউ চাকরি করলে বানভাসি۔ মেয়ের বাপমা বেয়াদপ কিচ্ছু শিখায় নাই ছেলের বাপ মা কিন্তু আদব, সস্তা ছেলে মানুষ করে নাই۔ এই আচরণ কিন্তু দ্বিচারিতা۔ সহজ ভাষায় বললে যিনি করছেন তিনি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড۔
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔
প্রশ্ন: ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কি ?
উত্তর: ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হল একজন মানুষের
মনস্তাত্বিক চয়েস; এটা সেই সদর দরজা যা
দিয়ে সে টক্সিক রিলেশনশিপে ঢুকে۔
এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি :
১. ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ব্যাক্তি কে প্রথমে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিন কোথায় কোথায় তিনি 2 জনের সাথে এমন 2 রকম আচরণ করছেন۔
২. এই রোগ ধরিয়ে দেওয়াটা দৃঢ়তা ও নমনীয়তার সাথে করতে হবে যাতে তিনি অসম্মানিত বোধ না করেন۔
৩. তিনি তার এহেন আচরণের পক্ষে একের পর এক যুক্তি উত্থাপন করবেন, প্রয়োজনে যিনি কনফ্রন্ট করছেন বা তার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণের দিকে আঙ্গুল তুলছেন তাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করবার চেষ্টা করবেন যুক্তি দিয়ে, রাগ দেখিয়ে, কান্না করে۔ যেমন বলবেন, “আমি তোর জন্য এতো কিছু করেছি আর এখন তুই অমুকের পক্ষ নিচ্ছিস ! নিমকহারাম! ” তখন দৃঢ়তার সাথে আপনার জন্য করা তার সকল ভালো কাজের প্রশংসা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলবেন, “জি আমি স্বীকার করছি আপনার সব অবদান, আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি, আপনি অনেক করেছেন আমার জন্য আর তাই আপনার সেই কোয়ালিটির প্রতি আস্থা রেখেই বলছি এখানে আপনি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণ করছেন۔ আমি জানি আপনি চাইলেই এটা শুধরে নিতে পারেন۔ “
৪. তাকে আস্বস্ত করুন যে, আপনি যেকোনো পরিস্থিতিতেই তাকে ভালোবাসেন, তার পাশে আছেন, থাকবেন এবং তিনি তার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ত্যাগ করলে আপনার কাছে তার সন্মান কমবে না বরং আরও বাড়বে۔
৫. এভাবে প্রতিটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ঘটনায় ভদ্রভাবে প্রতিবাদ করুন দেখবেন ক্রমেই কমে এসেছে۔ আর যদি না কমে তবে কিন্তু টক্সিক রিলেশনশিপের বিষের ছোবলে উভয়কেই পুড়তে হবে۔
পর্ব-১৮
দুটি মানুষের সম্পর্ক। সেই কলেজ জীবন থেকে প্রেম, বহু বসন্ত, শীত একসাথে পথ চলা। সূর্য পাক খেতে থাকে পৃথিবীর কক্ষপথে। অনেক অনেক দিন পরে সেই, একজন অন্যজনকে বলছে, “তোমাকে আর আমার প্রয়োজন নেই।” তারপরও অন্যজন দিনের পর দিন নিজেকে ভেঙেচুরে বদলে চেষ্টা করছে সেই একজনের একজনের মন জোগাতে। নিজেকে সেই একজনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে। ঠিক যেন কবির ভাষায়, ‘ মন দিয়ে মন পেতে চাহি, মন দিয়ে মন নিতে চাহি।’ এভাবে দিন যায় রাত যায়;পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সামাজিকতার বৃত্তের বাইরে পাছে লোকে কিছু বলে সব গণ্ডি পেরিয়ে সেই একজন আর অন্যজন আজ দুজনেই ক্লান্ত। একজন বলছে, “আমাকে মুক্তি দাও।” অন্যজন বলছে, ” আমিতো তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না ।” একজন বলছে, ” কিন্তু এভাবে দমবন্ধ করা এই সম্পর্কে আমরা ভালো নেই!” অন্যজন আমাকে আলাদা করে বলে, ” আপা, সত্যিই আমিও ভালো নেই। কিন্তু ছাড়তেও পারি না ভয় পাই, ওকে ছাড়া তো কখনো অন্য কিছু ভাবিনি, তাই বারবার আত্মহত্যা করতে চাই।” তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প। একজন যদি আটকে থাকতে না চায় আরেকজনকে কী বেঁধে রাখা যায়? বেঁধে রাখতে যেয়ে সে যদি কঠিন আঘাত করে সেই আঘাত কতটুকু নেয়া যায়? অন্য মানুষ কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তার জন্য আমি নিজের জীবনটাই শেষ করে দেবো? হুমায়ুন ফরিদীর একটা চমৎকার কথা আছে ঘুরে দাঁড়ানোর, তিনি বলেছেন, “উঠে দাঁড়াতে একটা হাত লাগে, আর ঘুরে দাঁড়াতে একটা আঘাত।” একটু কি ভেবে দেখা দেখা যায় নিচের প্রশ্নগুলি: ১. কে আমার হাত? ২. কেউ যদি হাত না বাড়ায় আমি কি নিজে নিজেকে হাতটি বাড়াতে পারি না? ৪. কে আমার আঘাত? ৫. আর কতগুলো আঘাত পাওয়ার অপেক্ষায় আছি ঘুরে দাঁড়ানোর আগে? ৬.আমি কি কাউকে জেনেশুনে আঘাত করছি? শুরু কিন্তু আমরা যেকোন সময়, যেকোন বয়স, যেকোনো দিন থেকে করতে পারি। নিজেকে সম্মানজনকভাবে আনন্দে কিভাবে রাখা যায় যেকোনো পরিস্থিতিতে সেটা শেখা শুরু করতে পারি না? যারা অন্যকে সম্মান করে তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
পর্ব-১৯
“It is a wise father that knows his own child.” – William Shakespeare.
ভদ্রলোক ব্যক্তিজীবনে একজন সহজ সরল বন্ধুবৎসল মানুষ। মানুষকে সাহায্য করাতে যতোটুকু পটু ঠিক ততোটাই নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কজনিত দরকারগুলিকে চিহ্নিত করে একটা সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদি টিকিয়ে রাখার জন্য যেই যেই চাহিদাগুলো স্ত্রীর থাকে সেগুলো বুঝতে অপটু। হেলাল হাফিজের কবিতার মতন, ‘ নিউট্রন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না ! ‘
ভালোবাসার বিয়ের যুগ পেরিয়ে গেছে। সংসার জীবন চলতে চলতে মধ্য বয়সী আজ দুজন। এমন সময় হঠাৎ একদিন,
ভদ্রমহিলা জানালেন,” আমি আর পারছি না তোমার সাথে,আমাকে মুক্তি দাও।”
ভদ্রলোক কোনভাবেই রাজী নন। ভদ্রমহিলা সামাজিক, অর্থনৈতিক, পেশাগত সবদিক থেকেই নিজেকে এবং সন্তানদেরকে বহনে সক্ষম।
ভদ্রলোক আমাকে বলছেন, “আমি কি তাহলে এতদিনে ইউজ হলাম তার দ্বারা? কারণ এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমি নিশ্চিত নই । “
একটা গান ছিল না ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর জীবনের বালুচরে! এই অবস্থা ভদ্রলোকের। এক শব্দে যদি বলি, ভদ্রলোক ভীষণ রিজেক্টেড ফিল করছেন। এখন তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ। তিনি আতঙ্কিত বাবা ছাড়া বাচ্চাগুলোর কি হবে?
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
বিবাহ একটি দলিলবদ্ধ সম্পর্ক। এক কলমের খোঁচায় সম্পর্ক তৈরি হয় আবার এক কলমের খোঁচায় সম্পর্ক ভেঙেও যায়। কিন্তু বাবা একটি বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক।বাচ্চার শরীরের তেইশটা ক্রোমোজোম বাবার কাছ থেকে আসে। কোন কিছুতেই এই সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না।
বাচ্চাদের প্রথম হিরো কিন্তু তাদের বাবা। ফলে ওয়াইফের সাথে যদি সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং সেটা হতেই পারে; (কিছু কিছু ধর্মে সম্পর্কচ্ছেদের অনুমতি দেয়া আছে আবার রাষ্ট্রীয় বিধানেও সম্পর্কচ্ছেদের অনুমতি আছে। ) কাজেই আমার ওয়াইফের সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেল দেখে আমার বাচ্চাদেরকে আমি হারায় ফেললাম এই কথাটা ভাবার কোন কারণ নেই।
বাচ্চাদের উপর বাবা এবং মা দুজনেরই অধিকার আছে। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চারা যার কাছে থাকে তিনি কিন্তু নিজে যা ফিল করছেন, যা ভাবছেন সেই নেতিবাচক চিন্তাগুলো তার সঙ্গীর বিরুদ্ধে বাচ্চাদের মনে ঢুকাচ্ছেন। এই কাজটা একদমই করা যাবে না।
কারণ বাচ্চারা কিন্তু ঠিকই ২০ বছর হোক ২৫ বছর হোক একটা সময় পরে নিজেরা যখন নিজেদের পারিবারিক জীবনে ঢুকবে, নিজে যখন বাবা-মা হবে তখন সে বাবা-মায়ের অসহায়ত্বের জায়গাগুলো আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে।
তাই বাচ্চাদেরকে নিজের দলে টানার চিন্তা যদি থাকে সঙ্গীকে অপদস্ত করার জন্য তাহলে, এটা একটা অসুস্থ চিন্তা।
জীবন সঙ্গীর সাথে বনিবনা হবে না দেখে দুজন দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে বাচ্চাদেরকে নিজের দলে টেনে একজন আরেকজনের দিকে তীর ছুড়ে ফেলাটা খুবই খারাপ একটা জিনিস, কারণ এতে শিশুমনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এই দাগ সারা জীবন বাচ্চাদের মধ্যে থাকবে। ভবিষ্যতে সঙ্গী নির্বাচনে তারা এই চিন্তাগুলো থেকে নানাভাবে প্রভাবিত হবে।
কাজেই বাচ্চাদেরকে দুজনের সাথেই সমান ভাবে মিশতে দিন। তাদেরকে তাদের বোধবুদ্ধি মতো বেছে নিতে দিন । বাচ্চারা সবই বুঝে। তাদেরকে তাদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্য মিলিয়ে সহজ ভাষায় তথ্যগুলো দিন । বাবা-মা অনেকেরই আলাদা থাকে; যতদিন যাচ্ছে এই কালচার আমাদের সমাজেও বাড়ছে। এখানে আপনার বা আমার কিছু করার নেই।
দুটো পরিণত বয়স্ক মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা একসাথে থাকবে না সেখানে শুধু শুধু বাচ্চা দিয়ে বেঁধে রেখে প্রতিদিন ঝগড়া তর্ক করে বাচ্চাদের বাবা এবং মা দুজনের সম্পর্কে নেগেটিভ ফিডব্যাক দেয়ার থেকে তারা যদি আলাদা হয়ে বাচ্চাদের সাথে প্রতিদিন হাসিমুখে যোগাযোগ রাখে বাচ্চারা অতটা খারাপ ফিল করবেনা। না হলে এই বাচ্চাই কিন্তু মার কাছ থেকে খারাপ কথা শুনে বাবা’কে অসম্মান করবে আবার বাবার কাছ থেকে খারাপ কথা শুনে মা’কে অশ্রদ্ধা করবে। বাচ্চাগুলা প্রচন্ডভাবে নিজেদেরকে শেকড় উপড়ানো ভাববে। নিজেকে কচুরি পানার মতো ভাসমান মনে করবে। না ঘরকা না ঘাটকা। নগর পুড়লে দেবালয় ও রেহাই পায়না। সংসারে আগুন লাগলে তার আঁচ বাচ্চাদের উপর ও পড়বে। এর থেকে রেহাই নেই। এখন দেখতে হবে এই ক্ষত যত দ্রুত বাচ্চাদের শুকায়।
তাই বাচ্চাদের বলতে হবে, ” তুমি বাবা এবং মা দুজনের কাছেই অনেক আদরের। আজকে কোন কারণে তারা একসাথে নেই তার মানে এটা নয় যে তোমাকে আমরা কেউ কম ভালোবাসি। তুমি যখন চাইবে যার সাথে চাইবে তখন সে ভাবেই তার সাথে থাকতে পারবে।”
বাবা-মার ব্রেকআপের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি যাতে বাচ্চাদের কোমল মনকে আক্রান্ত না করে সেটাই খেয়াল রাখা বাবা এবং মা উভয়ের প্রয়োজন ।
বাচ্চাদেরকে দলে টেনে যুদ্ধংদেহী বিধ্বংসী চিন্তা করে জীবনসঙ্গীকে বধ করার প্রচেষ্টা আসলেই অসুস্থ মানসিকতা।
যারা বাচ্চাদের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
পর্ব-২০
কখনো কখনো ভালোবাসার মানুষটিকে জীবনদেবতা ভেবে তার পায়ে কেউ কেউ নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করে দেয়। তখ হবন তার জীবনে ভালোবাসার মানুষটি হয়ে ওঠে ১০০ তে ১০০। অন্য কিছুর দিকেই আর খেয়াল থাকে না।
কিন্তু আমরা কি খেয়াল করে দেখি যে আমি ছাড়াও অন্য কেউ কি আছে তার জীবনে?
অনেক সময় আমরা টের পেলেও তাকে হারাবার ভয়ে এই কথা বলে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই যে, ” সে যেখানেই যাক, যার সাথেই সম্পর্ক করুক, দিনের শেষে সে আমার কাছেই ফিরে আসে.”
ঠিক যেন সেই গানের কথার মত,
‘তুমি যাও, পরিচিত কোন ডাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।’
এই ধরনের সম্পর্কে ভিকটিম তার ভালোবাসার মানুষটি ছাড়া আর কোন কারো কথা ভাবতে না পারলেও ভালোবাসার মানুষটির কাছে কিন্তু ভিকটিম শুধুমাত্র একটা অপশন; মোটেও ১০০ তে ১০০ না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরকম বহু ভিকটিম তার জীবনে এসেছে।একে পলিগ্যামি বলি বা পরকীয়া বলি যেটা যেভাবেই লেভেলিং করিনা কেন মূলকথা হলো ভালোবাসার মানুষের ছদ্মবেশের আড়ালে সে একজন ইউজার, ব্যবহার করে ভিকটিমের সারল্যকে।
এরকম অবস্থায় তথাকথিত ভালোবাসার মানুষটি ভিকটিমকে মানসিকভাবে, ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিকভাবে কখনো কখনো সামাজিকভাবেও দিনের পর দিন ইউজ করে। এই ইউজ একপর্যায়ে এসে অ্যাবিউজেও রূপ নিতে পারে।
অথচ ভিকটিম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু আকণ্ঠ ভালোবাসায় তার প্রিয় মানুষটির প্রতি এতই নিমজ্জিত যে সেসব কিছুই খেয়াল করতে পারেনা। ঠিক যেন সেই গানের কথার মতন,
” দিবসও রজনী তোমাতে স্বজনী
বাড়িঘর মাখামাখি,
ব্যাকুলও বাসরে, যে আলো দুঃখ
সে আলোতে আমি থাকি।”
আস্তে আস্তে ভিকটিমের জীবনে দুঃখের অমানিশা ঘনাতে থাকে। সঙ্গীকে হারানোর তীব্র ভয় তারপর সংগী থেকে বারেবারে রিজেকশন পাওয়ার দুঃখ, সব শেষে নিজের ভিকটিম পজিশন নিয়ে রাগ সব মিলিয়ে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নিজেকে দোষী ভাবা ছাড়া তার কাছে আর কোন উপায় থাকে না। ধীরে ধীরে কনফিডেন্স লেভেল কমতে থাকে। কিন্তু এরপরও সে ভিকটিম পজিশন থেকে বের হতে পারে না। তাঁর অবস্থা ঠিক যেন এই গানের কথার মতন,
“আকাশে ঘনালে মেঘ
বাকি পথ হেঁটে এসে,
শেষ হয়েও পড়ে থাকি অবশেষে।
নিভিয়ে দিয়েছি, ফুরিয়ে গিয়েছি
ডুবিয়েছি কত ভেলা,
প্রেমিক নাবিক জানেনা সাগর
একা রাখা অবহেলা।”
এই একা রাখা অবহেলা নিয়ে কত মানুষ যে ভিকটিম পজিশনে থেকে নিজের জীবনকে নষ্ট করে দেয় এমনকি কখনো কখনো চূড়ান্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তার কোন ইয়াত্তা নেই। একটু খেয়াল করলেই এমন প্রচুর মুখোশধারী তথাকথিত জীবনদেবতা খুঁজে পাবেন। এদের থেকে এখনই সতর্ক হন। কখনোই ভিকটিম পজিশানে নিজেকে ঠেলে দেবেন না।
যারা অন্যদের ইউজ করে না তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।