কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
পর্ব-৪১
মেয়েটি কলেজে পড়ে।
বাবা মা এনেছেন কাউন্সিলিংয়ের জন্য। মেয়েকে বাইরে বসিয়ে বাবা-মা রুমে আগে ঢুকলেন। ষড়যন্ত্রীদের মত নিচু গলায় বাবা বললেন, ” সমস্যাটা আমার মেয়ের, খালি একের পর এক ছেলের প্রেমে পড়ে। সেই জন্য আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”
আমি: ” ওকে কি বলে চেম্বারে এনেছেন?”
মা করুন কণ্ঠে বললেন: ” বলছি তোমার নাকে পলিপ, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে এনেছি। কারো সাথে মিশতে দেই না, একা বের হতে দেই না, সব সময় পাহারা দিয়ে রাখি তারপরও এই অবস্থা।”
আমি: ” আমিতো নাকের পলিপের ডাক্তার না। আপনার আমার কাছে থেকে কি চান?”
বাবা: ” ওকে প্রেম থেকে ছুটায় নিয়ে আসেন। কারন যেই ছেলেগুলোর সাথে প্রেম করছে কোনটাই ভালো না।”
আমি: ” আপনার অসহায়ত্বের জায়গাটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু মেয়েটি যদি নিজে থেকে কাউন্সেলিং নিতে না চায় ওকে জোর করে কাউন্সেলিং করানো যাবে না। আপনারা দেখেন সত্য কথা বলার পরে সে যদি রাজি হয় তবে তাকে আমার রুমে নিয়ে আসেন। আর সেটা একটা স্পেসিফিক কারণ হতে হবে।”
মা: ” তাহলে বলি ওর খুব বেশি রাগ সেই জন্য ডাক্তার দেখাতে আনছি?”
আমি: ” মেয়ে যদি এই ব্যাপারে কথা বলতে রাজি থাকে তবেই বলবো, কিন্তু ও কে না জানিয়ে আমি সেশন নেব না। এতে কাজ হবে না। কারণ আপনার এত বছরের ভালোবাসা যত্নের পরেও যদি সে একাধিক প্রেম থেকে বিরত না হয়, তাহলে আমার এই অল্প কিছু সময়ের সেশন থেকে কেন সে প্রেম করা বন্ধ করবে? আর আমি ওকে প্রেম করা বন্ধ করতে বলার কে? কেন আমার কথা শুনবে? আমি ভিজিট পাবো, আমার লাভ হবে, কিন্তু আপনার পয়সা খরচ করেও লাভ হবে না।”
এরপর বাবা-মা ওয়েটিং লাউঞ্জে গেলেন। কিছু একটা বোঝালেন। মেয়েকে নিয়ে রুমে ঢুকলেন।
আমি: ” আমি ওর সাথে একা কথা বলবো। আপনারা যদি বাইরে বসতেন ভালো হতো।”
বাবা মা চলে গেলেন। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ” তুমি জানো আমি কি করি?”
মেয়েটি: ” আমাকে বলেছিল নাকের ডাক্তার, এখন বলছেন আপনি আমার রাগ নিয়ে কাউন্সেলিং করবেন।”
আমি: ” তুমি যদি চাও, আমরা এটা নিয়ে সেশনে বসতে পারি। তোমার কথা আমি কারো সাথে শেয়ার করব না। এটা আমাদের মধ্যে কনফিডেনশিয়াল থাকবে। বাবা মার পক্ষ হয়ে তোমাকে কোন উপদেশ দেব না। তুমি চাইলে আমার সাথে কথা বলতে পারো আর সেটা ইচ্ছা না হলে নির্দিষ্ট সময় যতটুকু বরাদ্দ, ততক্ষণ থেকে তুমি চুপচাপ বেরিয়ে যেতে পারো। কোন অসুবিধা নেই। চা খাবে?”
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
বাসার সবচেয়ে ছোট বাচ্চা হওয়ায় বাবা-মার সাথে অনেক রকম বিধি-নিষেধের বেড়া মেয়েটার নিঃশ্বাস নেওয়াটা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর দশ জন মানুষের মতই মেয়েটি প্রত্যেকটি সম্পর্কে একটা জিনিসই খোজে, সেটি হল অ্যাটেনশন। বাসায় সবাই বড় বলে, সব সময় উপদেশ দিত এটা করো, সেটা করো বলে। কথায় কথায় অপমান, তার পেছনে টাকা খরচ হওয়ার খোটা, আত্মীয়দের সামনে অন্যের সাথে তুলনা কোন কিছুর কমতি ছিল না। কাজেই এক ছাদের তলায় থেকেও ভাত কাপড় সবকিছু দেওয়ার পরেও, মেয়েটার সাথে তার পরিবার একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি ও তার পরিবারের এই দুই মনোজগতের মাঝে কোন সংযোগ সেতু ছিল না।
মানুষের চারটা বেসিক ফিলিং থাকে। আনন্দ, দুঃখ, রাগ, ভয়। এ বিধি-নিষেধ আরোপ আর উপদেশের পাহাড় ক্রমশ তাদের মাঝখানে রাগের পাল্লা ভারী করছিল। ধীরে ধীরে দূরত্ব বার ছিল। অথচ মেয়েটা ভেতরে ভেতরে চাইত তার পরিবার তাকে unconditionally বা কোনো শর্তহীন ভাবে তার অস্তিত্বকে গ্রহণ করুক।
আমরা সব সময়ই সন্তানদেরকে তার doing এর জন্য বা ভাল কাজ করার জন্য উৎসাহিত করি। রেজাল্ট ভালো করলে সাইকেল কিনে দেই। কিন্তু প্রতিদিন তো মানুষের রেজাল্ট ভালো হয় না। আমরা প্রত্যেকটা মানুষ প্রতিদিন আমাদের অস্তিত্বের বা being এর জন্যও মানুষের থেকে সেই স্বীকৃতি চাই। প্রথম স্বীকৃতি পরিবার থেকে খুঁজি। সেখানে যদি খালি খূত ধরা, শুধরে নেওয়া আর উপদেশের বন্যা হয় সেই মানুষগুলোর থেকে আমাদের আনন্দ পাওয়ার পরিমাণটা একদম শুকিয়ে যায়। ফলে আমরা বাইরের মানুষ থেকে সেই আনন্দ খুঁজি; যে আমাকে আমার মতন করে গ্রহণ করবে।
মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সবার উপদেশের ঠেলায় মেয়েটি ক্লাস সেভেন থেকে একের পর এক প্রেমে জড়িয়েছে। প্রত্যেকটা প্রেমই যখন সে দেখেছে প্রেমিক প্রবরটি তাকে তার মতন করে গ্রহণ করছে না তখন সে সেই সম্পর্কটিকে পুরাতন কাপড়ের মতন ফেলে নতুন আরেকটি সম্পর্কের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
মেয়েটি আসলে খুঁজছে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার আনন্দ, যেখানে তাকে তার মতন করে গ্রহণ করা হবে।
সেশন শেষে বাবা-মাকে ডাকলাম, বললাম, ” আপনার মেয়ে আপনাদেরকে ভালবাসে, সম্মান করে, খালি এখন থেকে দেখবেন, কেউ যেন ওকে অসম্মান না করে।”
রুমের আয়নাটি দেখিয়ে বললাম, ” আজকে থেকেই আয়নাটার কথা মনে রাখবেন, আমরা বাচ্চাদেরকে যা দেই বাচ্চারা সেটারই প্রতিবিম্ব আমাদেরকে ফেরত দেয়। আমি রাগ দিলে, রাগ ফেরত দেবে, শ্রদ্ধা দিলে শ্রদ্ধা ফেরত দেবে। খেয়াল রাখবেন কেউ যেন ওকে অশ্রদ্ধা না করে। আপনার বাচ্চাকে আপনার থেকে ভালো কেউ বেশি ভালোবাসে না। একবার নিজেকে ওর বয়সের মনটাতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। তখন যা যা ভালো লাগতো তাই করেন, অভিভাবক না হয়ে ওর বন্ধু হয়ে যান। দেখবেন আপনার মেয়েও আপনার বন্ধু হয়ে গেছে। ওইসব প্রেম-ট্রেম কোথায় হাওয়ায় উড়ে গেছে।”
সন্তান আলাদা মানুষ। তার ভালোলাগা, মন্দলাগা, সম্মানবোধ সব আলাদা। ভুল করলে অবশ্যই তাকে সঠিক ইনফরমেশন দেবেন। কিন্তু তাই বলে তাকে অসম্মান করার কোন অধিকার পিতা-মাতার নেই। সন্তানের ভিন্নতাকে যারা সম্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
পর্ব-৪২
আমার চেম্বারে সবসময় পর্দা সরিয়ে রাখি। শীতের নরম রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। কিছু কিছু মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এই মানুষটি সেরকম।
তিনি বললেন: ” মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বাবা মাকে যদি খুন করতে পারতাম, তবে শান্তি পেতাম।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, পলকেই হাসিখুশি মুখটা পাল্টে গেল। দেখি কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, প্রচন্ড আক্রোশে আর জিঘাংসায় শ্বদন্ত বেরিয়ে পড়েছে।
মানুষটির বয়স ৩২ বছর। প্রচলিত বিয়ের বয়স সীমানা পারের কাঠগড়ায়। পেশাগত জীবনে এর মধ্যেই পিএইচডি, আন্তর্জাতিক প্যানেলে আমন্ত্রিত বক্তা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ফটোগ্রাফি ইত্যাদি বহু স্বীকৃতি তার ঝোলাতে।
বাবা-মা, পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজন সবাই চাইছে এখন সে বিয়েথা করে থিতু হোক। সেই আবদার রীতিমতো এখন অত্যাচারে পরিণত হয়েছে।
মানুষটি বললেন, ” বাইরের মানুষ না বুঝুক আমার বাবা-মা তো জানে, তারপরও কিভাবে তারা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর? বিয়ে করলে কি আমার সমস্যার সমাধান হবে? আমি আর নিতে পারছি না।”
জলভরা চোখে বাবা বললেন, ” কতটুকু অর্থ, সময় ব্যয় করেছি শুধু ওর জন্য, ওর ভবিষ্যৎ ভালোর জন্য, সুস্থ জীবনের জন্য। অথচ ও কি নোংরা গালি দেয় আমাদেরকে।”
মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” সব সময় আগলে রেখেছি বুকে করে, যাতে কেউ কখনো বুঝতে পারে না, কখনো কারো বাসায় নিয়ে রাত কাটাই নাই, যাতে কেউ ধরতে না পারে। গয়না, প্রফিডেন্ট ফান্ড কিচ্ছু নেই বিদেশে এতবার অপারেশন করানোর জন্য। অথচ আজকে আমিই অপরাধী?”
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
ছোটবেলায় ধরা পড়ে তার বৃহন্নলারূপ। বাচ্চাটা কিছু বোঝার আগেই, বাবা-মার পছন্দ মোতাবেক অবুঝ শিশুটিকে বারবার সমর্পিত হতে হয় চিকিৎসকদের ছুরি-কাঁচির নিচে সেক্স চেইঞ্জ সার্জারির জন্য।
বাবা-মা দুজনই অতীব উচ্চপদস্থবিধায় পাছে লোকে জেনে ফেলে, পাছে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, পাছে পদোন্নতিতে সমস্যা হয় এত পাছে লোকে কিছু ভাবতে ভাবতে বাবা-মা বুঝতেই পারেননি তাদের সাথে নিজের বাচ্চার সম্পর্কটাই কখন বহুদূর পিছিয়ে পড়ে গেছে গেছে।
বাচ্চাটা নিজের একান্ত ভরসার স্থল বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছে পাছে লোকে কিছু ভিড়ে। বাবা-মাকে মুখোমুখি করে দিয়েছে এই কাউন্সেলিং টেবিলে।
একবার শুধু চিন্তা করুন, আপনি মানসিকভাবে একজন পুরুষ, অথচ ছোটবেলায় সেক্স চেঞ্জিং অপারেশন করে প্রাপ্তবয়স্ক বেলায় অন্য একজন পুরুষের সাথে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে আপনাকে। কেমন লাগবে আপনার? অথবা আপনি মানসিকভাবে নারী, কিন্তু ছোটবেলায়, সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করে, আপনাকে পুরুষ বানানো হয়েছে সামাজিকভাবে। এখন বড় বেলায় আরেকজন নারীর সাথে বিয়ে দেওয়ার চাপ দেয়া হচ্ছে আপনাকে ; কেমন লাগবে?
শিশুদের সেক্স চেঞ্জ সার্জারি এখন প্রশ্নবিদ্ধ ইথিক্যাল ইস্যুতে উন্নত বিশ্বে। কারণ যৌনতার ধারণা ও সেক্সুয়ালিটি ওরিয়েন্টেশন সেই ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। এটা ধীরে ধীরে তার জামার ঝুলের সাথে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, কৈশোরে হালকা অবয়ব আসে, তারুণ্যে তা মূর্ত হয়ে ওঠে। শৈশবে হয়তো সেই ব্যক্তি বুঝতেও পারেনা তার সেক্সচুয়াল অরিয়েন্টেশন কি। শিশুদের তো আমরা নারী-পুরুষ ভাগে ভাগ করি না। অথচ তখনই বাবা-মা যদি তাদের সন্তানকে সার্জারি করিয়ে ফেলেন পরবর্তীতে এটা ভয়ংকরভাবে সন্তানের উপর আত্মঘাতী হতে পারে। ( সার্জারি বলতে এখানে শুধু আমি সেক্সের চেইঞ্জ সার্জারিই বুঝাচ্ছি, শুধুমাত্র সামাজিক মুখ রক্ষার জন্য করা হয়। অন্য জীবনরক্ষাকারী রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি নয়)
আমাদের এই পৃথিবীর সৌন্দর্য হচ্ছে এর ডাইভারসিটি। প্রকৃতি তার বিশালত্বের রূপের ডালি আমাদের সামনে সাজিয়েছে অনাদি কাল হতে। আমরা কেউ কারো মত না। সেরকম হলে তো প্রথম থেকেই পৃথিবীতে শুধু ক্লোন থাকতো, এত বৈচিত্র থাকতো না।
ভিন্নতা গ্রহণ করাটা জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। ভিন্নতা গ্রহণ করাটা সহনশীলতা। যারা ভিন্নতাকে সম্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
পর্ব-৪৩
ভদ্রলোকের বয়স ৫২, মার্জিত, অমায়িক, স্বল্পবাক, সুদর্শন। অধ্যাপনা করেন। স্ত্রী প্রাক্তন সহপাঠী, এখন বিদেশে সম্মানজনক পদে কর্মরত। দুজন দু’দেশে থাকেন। বাচ্চারাও চমৎকার ভাবে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছে।
আমার কাছে আসার কারণ হিসেবে ভদ্রলোক বললেন, ” আমি আসতে চাইনি, আমার স্ত্রী জোর করেছেন। ওর ধারনা আমার কাউন্সেলিং লাগবে।”
আমি: ” কোন চিন্তাটা থেকে ওনার এই ধারণা হলো?”
ভদ্রলোক: ” কিভাবে বলি?”
আমি: ” বেশ, প্রশ্নটা তাহলে এভাবে করি, আপনার কোন আচরণ আপনার স্ত্রীকে এই ধারণা তৈরিতে সাহায্য করেছে?”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বুঝলাম ভাবছেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম: “ইংরেজীতে একটা কথা আছে, out of sight out of mind. আপনাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য সম্ভবত নয়। না হলে স্ত্রীর কথায় আপনি আমার চেম্বারে আসতেন না। স্বামীস্ত্রীর আন্ত:সম্পর্কে কোন জিনিসটা আপনি ও আপনার স্ত্রী দুজনেই মিস করছেন?”
ভদ্রলোক চশমা মুছে, আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” ইন্টিমেসি।”
আবার কিছুক্ষণ বিরতি। আমি চুপ।
লম্বা একটা শ্বাস টেনে ভদ্রলোক বললেন, ” আমরা বহু ঝড়ঝাপ্টার ভেতর দিয়ে গেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর থেকে প্রেম। বহুবার পড়াশোনা বা পেশাগত প্রয়োজনে আমরা আলাদা থেকেছি। কিন্তু কখনোই আমরা বিচ্ছিন্নবোধ করিনি। আমি কিছু বলার আগেই ও আমার মনের কথা বুঝে যায়। ওর চোখের দিকে তাকালেই আমি ওর কথা বুঝে ফেলি। আমাদের দুজনের মাঝখানে কোন তৃতীয় পক্ষ নেই। অথচ ইদানিং আমি ওকে বুঝতেই পারিনা।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আমাদের খিদে দুই রকম। একটা দৈহিক ক্ষুধা, আরেকটি মানসিক ক্ষুধা। দৈহিক ক্ষুধা তো খাদ্য বা যৌনতা দিয়ে নিবৃত্ত হয়। কিন্তু মানসিক ক্ষুধার নানাবিধ রকমফের আছে।
আমরা মানুষ হিসেবে চাই, আমি যেরকম, ঠিক সেভাবেই আমাকে আমার দোষ, গুণ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, লজ্জা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা, সাফল্য ইত্যাদি জেনেই সামনের মানুষটি আমাকে গ্রহণ করুক। আমার ভয়, দুঃখ, আনন্দ, রাগে পাশে থাকুক।
যেকোনো আন্ত সম্পর্কে, ভালোবাসার থেকেও বেশি প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মানবোধ। আমরা যদি মানুষটিকে সম্মান না করতে পারি, তবে যত ভালোবাসাই থাক, সেই সম্পর্কে চিড় ধরবে। এই চিড় সামান্য একটা অস্পষ্ট দাগ থেকে ফাটল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
অনেক সময় ভালোবাসার দুটো মানুষ খুব বেশি কাছাকাছি থাকলেও, নিজেদের মধ্যে বৃদিং স্পেস থাকে না। এই গা ঘেষাঘেষি বড্ড বেশি ভালোবাসাতেও অনেক সময় হাপ ধরিয়ে দেয়। তাই প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটা বৃদিং স্পেস প্রয়োজন।
ভদ্রলোকের সম্পর্কটিতে বৃদিং স্পেস একদম নেই। সম্পর্কটি হয়ে গেছে একঘেয়ে বাসি নুন পোড়া পান্তার মতন।
অপরজনকে মুগ্ধ করার চেষ্টা আমরা সম্পর্ক তৈরীর শুরুর দিকে করি। তার মনে নিজের প্রতি আকর্ষণ তৈরির নিরন্তন চেষ্টা করি। কিন্তু আস্তে আস্তে যত সম্পর্ক গাঢ় হয়, আমরা মনে করি, ওকে তো পেয়েই গেলাম। এখন আর মুগ্ধ করার প্রচেষ্টার দরকার নেই।
এই ধারণাটি থেকে সরে আসা প্রয়োজন। শুরুতে যেটি বলেছিলাম, ‘মানসিক ক্ষুধা’। কেউ আমাকে মুগ্ধ করুক, যত্ন করুক এগুলো হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক ক্ষুধা। এই মানসিক ক্ষুধা আমাদের প্রত্যেকের আছে। অপরজনের জন্য এই ক্ষুধা নিবৃত্ত করা আন্তঃসম্পর্কের একটি বাস্তবতা। এটা যে শুধু জীবন সঙ্গীর জন্য করবেন তা কিন্তু না। আমরা সন্তানদের জন্য, বন্ধুদের জন্য ও করবো।
কাজেই সম্পর্ক যতই পুরোনো হোক না কেন, আপনার জীবন সঙ্গীকে মুগ্ধ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন। তার মানে কিন্তু আপনাকে পাহাড় ডিঙাতে হবে না। আপনার প্রাত্যহিক ছোট্ট একটি আচরণ / কথা অথবা বাজেটবান্ধব ছোট্ট উপহার এই মুগ্ধতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তার জন্য কাউন্সিলর বা সাইকোথেরাপিস্টের দরকার নেই।( অবশ্য সবাই এই কাজ করলে আমার পেটে লাথি পড়বে
)

একটা গান আমার খুব প্রিয়। কথাগুলো এরকম, ” তোমাকে বুঝিনা প্রিয় বোঝনা তুমি আমায় দূরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়।”
অনেক সময়, বেশি বেশি কাছাকাছি আসলেও দম বন্ধ অবস্থায় তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতি ছাড়াও যোগাযোগ নিভে যায়।
যারা জীবনসঙ্গীকে সম্মান করেন, জীবন সঙ্গীর প্রতি নিজের সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখেন, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-৪৪
ভদ্রলোকের বয়স ৪৫, পেশায় বৈমানিক, গোপনে প্রকাশ্যে মিলিয়ে এর আগে বিয়ে করেছেন মোট চারটা। এবার তিনি পঞ্চম বার পুনরায় পাণীগ্রহণে আগ্রহী। এতদিন তিনি কনফিডেন্ট ছিলেন। মিলে নাই তাই, একটা বিয়ে ভেঙে নতুন আরেকটা বিয়ে করেছেন।
তার ভাষায়,” এতদিন ভেবেছি এমনটা হতেই পারে। মানুষ একাধিক বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু এবার যখন পাঁচ নাম্বারবার বিয়ে করবো সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমার এক বন্ধু, কাউন্সেলিং এ আসতে বুদ্ধি দিল। প্রথমে রাগ করলেও পরে আমিও ভাবলাম দেখিতো কি হয়? ইদানিং, যখন বন্ধুদের বাচ্চাদের স্কুল যেতে দেখি, তখন মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। “
আমি: ” আমার কাছে কেন এসেছেন?”
ভদ্রলোক, ” প্রথমত আপনি মহিলা, দ্বিতীয়তঃ আপনি ডাক্তার এবং কাউন্সিলর। “
আমি: ” ডাক্তার এবং কাউন্সিলার শব্দদুটো কিন্তু ইউনিসেক্স। আপনার কথা থেকে একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো, আপনি কি জেন্ডার বায়াসড ? “
চোখ ছোট ছোট করে ভদ্রলোক একটু বোঝার চেষ্টা করলেন, আমার এই কথাটার মধ্যে কোন অপমানের সূক্ষ্মতা আছে কিনা.
আমি বললাম: ” একই প্রশ্নটা এভাবে করি, আপনি কি প্রত্যেকটা পেশা’কে জেন্ডার ভেরিয়েশনের বেসিসে দেখেন?”
ভদ্রলোক আবার চোখ ছোট ছোট করে দেয়ালের দিকে তাকালেন।
আমি: ” আপনি বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে কোন জিনিসটা চান, যেটা গত ৪টা বিয়েতে পান নাই, এবং সেই একই জিনিসের খোঁজে আপনি পঞ্চম বারের মতন নতুন সম্পর্কের কথা চিন্তা করছেন ?”
ভদ্রলোক: ” শান্তি। “
আমি হেসে ফেললাম।
বললাম, ” সেটা তো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই কামনার ধন। শুধুমাত্র বনলতা সেনই আলাদা করে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল জীবনানন্দ দাশকে। কিন্তু জরুরী কথা হল এই বনলতা সেন কিন্তু কোনো বাস্তব চরিত্র নয়। অর্ধেক মানুষ সে অর্ধেক কল্পনা। আমরা যখন আরেকজন মানুষের কাছে কিছু এক্সপেক্ট করি, তখন সেটার প্যারামিটারগুলো কি আইডেন্টিফাই করতে পারি? যেমন ধরুন, খুব সোজা ভাষায় যদি বলি, আপনি এক্সপেক্ট করেন আপনার স্ত্রী রান্না করবেন। এখন আমার প্রশ্ন হল, আপনি কি এটা জব ডেস্ক্রিপশনের মতন নির্দিষ্ট করেছেন যে এই রান্না করার প্যারামিটার কি কি? দিনে কয় বেলা রান্না করবে, কয়বার রান্না করবে? প্রতিবারে কত পদ রান্না করবে? প্রতিপদে কতটুকু পরিমান রান্না করবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আমার প্রশ্ন, প্রতিটা বিয়ে থেকে আপনি কি চান?”
ভদ্রলোক আবার কিছুক্ষণ চুপ। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন,” আমি কি আপনার সামনে স্মোক করতে পারি?”
আমি: ” সরি। এখানে না। আপনি চেম্বারের বাইরে বারান্দায় যেয়ে করতে পারেন।”
ভদ্রলোক: ” It’s ok.
আমি: ” থ্যাংকস। আমরা আবার প্রসঙ্গে ফেরত আসি। আপনি বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে কি খুঁজেন?”
ভদ্রলোক: ” ঠিক বুঝতে পারছিনা। এভাবে ভাবিনি আগে। আপনি চমৎকার ভাবে কথা বলেন। এভাবে কোন ভদ্রমহিলা এর আগে আমার সাথে আগে কথা বলেনি। “
আমি: ” এই জায়গাটায় আমি একটু আপনাকে খেয়াল করতে বলি। আপনি কি কথাটা জেন্ডার বায়াসড চিন্তা থেকে বললেন? ডাক্তার কাউন্সিলর এই শব্দগুলো কিন্তু নারী-পুরুষ বাচক না।”
ভদ্রলোক: ” আমি আপনার কথায় মুগ্ধ হচ্ছি।”
আমি: ” আপনি কিন্তু মুগ্ধ হতে এখানে আসেননি।”
ভদ্রলোক: ” ঠিক। কিন্তু আপনি চমৎকার কথা বলেন।”
আমি: ” যেহেতু আমি কথা বিক্রি করে খাই, কাজেই পেশাগত মিষ্টতা আমার কথায় থাকবেই। এটা আমার রুজী রুটির ব্যাপার; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমার আরেকটি চেহারা আছে। সেখানে আমার দাঁত এবং নখের ধারের কমতি নেই।”
ভদ্রলোক, ” আপনি কেমন পুরুষ পছন্দ করেন?
আমি : ” সেই উত্তরটি জানার জন্য আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভিজিট দিচ্ছেন না। আমি আপনাকে একটা হোমওয়ার্ক দেবো। সেখানে আপনি স্পেসিফিক্যালি লিখবেন স্ত্রীর কাছ থেকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে আপনি কি চান? কেন চান? কতটুকু চান? কিভাবে চান? এগুলো পেতে গেলে, এই সম্পর্কে স্বামী হিসেবে আপনাকে স্পেসিফিকালি কি কি রোল প্লে করতে হবে? কেন করতে হবে? কিভাবে করতে হবে? কতদিন ধরে করতে হবে? কতটুকু করতে হবে? আগের সম্পর্কগুলোতে এর কোন কোন উপাদানগুলো অনুপস্থিত ছিল? প্রত্যেকটা টপিকের উপর অন্তত পাঁচটি করে পয়েন্ট কাগজে-কলমে লিখবেন। তারপর আমরা আবার সেশনে বসব।”
ভদ্রলোক: ” কোথাও যদি না বুঝি, আমি কি আপনাকে ফোন করতে পারি? আপনার নাম্বারটা যদি দিতেন।”
আমি: ” এই যে কথাটা বললেন, সেই কথার প্রেক্ষিতে একটা জায়গাটায়, আপনাকে একটু খেয়াল করতে বলবো, অন্যান্য নারী বনাম বিবাহিত স্ত্রীর কাছে আপনি কি চান? স্ত্রী বাদে অন্য মহিলাদের সাথে আপনার আচরণের বাউন্ডারি কতটুকু? আর আমি ফোনে কথা বলি না মেসেজও দেবেন না। “
তারপর সে কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোক আসলে মায়া হরিণের পেছনে ছুটছেন। রিয়েলিস্টিক, চিন্তার বাইরে। এটা তার একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের ভেতরের একটা অংশ জানে, “Cheating is not a mistake, it’s a choice.” কিন্তু, তিনি সেটা মানতে চান না। এ ধরণের মানুষরা, সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে থাকে। সোনার হরিণ শব্দটা, যদি নারী দেহে প্রতিস্থাপিত করি, তবে বাক্যটা এমন হবে। এধরনের পুরুষরা, যতক্ষণ পর্যন্ত না টার্গেটেড নারীটি তার জালে ধরা পড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নারীটিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করে। একবার যখন সেই নারীটিকে মনোদৈহিক ভাবে অধিকার করে তখন তার প্রতি হঠাৎ করে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার নতুন করে শিকার খুঁজতে শুরু করে।
এ ধরনের মানুষরা মেকি মুখোশের আড়ালে আমাদের আশেপাশে ঘাপটি মেরে বসে আছে। কাজেই সাধু সাবধান।
যারা আন্তঃসম্পর্কগুলোকে সম্মান করেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-৪৫
“ম্যাডাম আপনার কত টাকা লাগবে? যা বলবেন তার একশগুণ দেবো, খালি আমার বউকে ঠিক করে দেন।” ভদ্রলোকের বক্তব্য।
ভদ্রলোকের বয়স ৪৩, স্ত্রীর বয়স ১৮। বিয়ে হয়েছে বছরখানেক। এর মধ্যে অন্তত দশবার বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। প্রতিবারই বাপের বাড়ি থেকে জামাইকে ডেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েটাকে স্বামীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
মেয়ের মায়ের ভাষ্য: “স্বামী হলো সোনার আংটি। সোনার আংটি বাঁকা হলেও চলে। চরিত্র ভালো, মদ, গাঁজা, পান, বিড়ি, সিগারেট, মেয়ে মানুষের দোষ নাই। এরকম সোনার টুকরা ছেলে কই পাবে?”
মেয়ের বাপের কথা: “ঢাকা শহরে শুধু গুলশান এলাকায় দুইটা বাড়ি, বনানীতে দুইটা বাড়ি, মহাখালীতে একটা বাড়ি, চিটাগংয়ের খুলশীতে দুইটা বাড়ি, খুলনায় দুইটা বাড়ি, মালয়েশিয়ায় ভিলা, ব্যবসাপাতির বরকত, কিছুরই কমতি নাই । এরকম জামাইতো লাখে একটা মিলে। এই অসভ্য মেয়ে যে কাউকে কিছু না বলে বারে বারে বাপের বাড়ি চলে আসে জামাই ভালো না হলে কি ফেরত নিয়ে যায়? এ জামাইয়ের জন্য কি মেয়ের অভাব? এমন ছেলের জন্য তো মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়ায় থাকে।”
আমি: ” আমি কথা বলবো মেয়েটার আলাদা করে। আপনাদের থেকে শুনতে চাই না। কারন আমি সাধারন মানুষ তো। বায়াস্ড হয়ে যেতে পারি।”
মেয়েটা একাই ঢুকলো চেম্বারে। দেখে প্রথম যে কথাটা মনে হল, এর বয়স কত? ভারী একটা কাতান শাড়ি পরা। শাড়ির ওজন, নাকি মেয়েটার ওজন বেশি আমি কনফিউজড।
মাথা নিচু করে এক কোণে বসলো। বিধাতা এত অপূর্ব করে একটা মানুষকে তৈরী করতে পারেন? সৃষ্টিকর্তা নিজে সুন্দর না হলে এতো অপরূপ একটা মানুষ তৈরি করতে পারতেন না। বসতে বসতে মেয়েটির এলো খোঁপা খুলে গেল। ঝরনার মত চিকমিকে এক ঢাল চুল গড়িয়ে পড়ল হাঁটুর নিচে। আমি আবার কনফিউজড হয়ে গেলাম, এই চুলের নাকি মেয়েটার ওজন বেশি?
আমি প্রশ্ন করলাম: ” তোমাকে কি বলে আমার কাছে এনেছে?”
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে।
আমি: “বললাম থাক। কথা বলতে ইচ্ছা না হলে কিছু বলতে হবে না। তুমি চা খাবে?”
আলতো করে মাথা নাড়লো নেতিবাচক ভঙ্গিতে।
আমি বললাম: ” তোমার জন্য আমার দেড় ঘন্টা সময় বরাদ্দ আজকে। তোমার সাথে আমার যা যা কথা হবে, বা হবে না সেটা আমি কাউকে বলবো না। কাজেই এই সময়টা চলো তুমি, আমি গল্প করি। তোমার স্বামী, মা-বাবা বাইরে অপেক্ষা করছে করুক। দেড় ঘন্টা তুমি বের হয়ে যাবে। আমি বলব না যে তুমি কিছু কথা বলোনি।”
মেয়েটা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। প্রায় ঘন্টাখানেক কাঁদলো এক মনে। আমি চুপ করে বসে থাকলাম। শুধু দশ মিনিট পরে উঠে ওর হাতটা ধরেছিলাম। একসময় কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার চোখের পানি থাকলো না। তারপরও মেয়েটা কেঁদেই গেলো শুকনো চোখে পাথরের মূর্তির মতন বসে।
এক ঘন্টা পর মেয়েটা বলল, “আপনার কাছে নিয়ে এসেছে, আমি যাতে সংসার করি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
স্বামী পুঙ্গব স্যাডিস্ট। বিয়ের প্রথম রাতেই মেয়েটাকে ইমারজেন্সিতে নিতে হয়েছিল পেরিনিয়াল টিয়ার বা যোনিপথে ক্ষত নিয়ে। অনেকগুলো সেলাই দিতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে একাধিক ব্যাগ। পরদিন যখন মেয়েটিকে কেবিনে ফেরত দিয়েছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন মেয়েটির কানে এসেছে, একজন আরেকজনকে হাসতে হাসতে বলছে, ” ফাটিয়ে দিয়েছ।”
এই লকডাউন এর মধ্যে প্রতিদিন অবিরাম ভদ্রলোক তার স্বামীত্বের অধিকার নিয়ে এই যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন ঘন্টায় ঘন্টায়।
ফলশ্রুতিতে একাধিকবার মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে। একমাত্র আশ্রয়স্থল বাবা মার বুকে যতবার পালিয়ে গেছে ততোবারই বাবা-মা স্বামীকে ডেকে মাফ চেয়ে মেয়েটিকে তার হাতেই তুলে দিয়েছে। এমনিতেই কিন্তু মেয়েটিকে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত যখন মেয়েটি যখন আত্যহত্যার চেষ্টা করেছে, তখন তারা কাউন্সেলিং এর জন্য আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
“ম্যারিটাল রেপ” বা বিবাহিত সম্পর্কে থাকা অবস্থায় স্বামী কর্তৃক ধর্ষণ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের বড় সংখ্যক নারী এর ভুক্তভোগী। কিন্তু আফসোস বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি মেয়েটার বাবা-মা এবং স্বামী তিনজনকেই সেশন শেষে চেম্বারে ডাকলাম। বললাম, ” হেলথের ডেফিনেশন কি জানেন ? Health is a state of physical, mental and social well-being….. ,কাজেই শারীরিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মানসিক স্বাস্থ্য একা কিভাবে ভালো থাকে? আমি জানি আপনারা মেয়েটিকে আপনাদের মতন করে ভালোবাসেন। কিন্তু আপনাদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবগুলো মেয়েটির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার সাথে একই প্লাটফর্মে নাই। তাই আমি আপনাদের তিনজনকেই ফ্যামিলি কাউন্সেলিং সাজেস্ট করবো। এই মেয়েটিকে আমি বাচ্চাই বলবো। বাচ্চাটি এখন যেকোন ধরনের দৈহিক সম্পর্ক বা মানসিক চাপ নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। ওকে কিছুদিন বাবার বাসায় কি রাখা যায়? শুধু কাউন্সেলিং করে এই মেয়েটা ভালো হবে না। এই বিয়েটা অত্যাচারের সমতুল্য হিসেবে ওর শরীর এবং মনে দাগ কেটেছে। এই মেয়েটা যদি এখন আত্মহত্যা করে এই দায়ভার কিন্তু আপনাদের তিনজনের উপরই বর্তাবে। “
মাঝে মাঝে আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। কিছু কিছু কেসে অনুভব করি চরমতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের। খুব কষ্ট লাগে যখন এদের জন্য কিছু না করতে পারার অক্ষমতায়।
আমি তীব্র কড়াভাবে ছেলেটিকে ধুয়ে দিতে পারতাম, বাপ মাকে ধুয়ে দিতে পারতাম কিন্তু দিনের শেষে মেয়েটিকে তো আমি আশ্রয় দেবো না। মেয়েটিকে তাদের হেফাজতেই থাকতে হবে।
আমার পরিচিত কিছু শেল্টার হোম আছে, কিন্তু সেগুলোর পরিবেশ এমন আশাব্যঞ্জক নয় যে আমি বড় মুখ করে মেয়েটিকে সেই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেবো।
রবীন্দ্রনাথের আমলে “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নি।” রবীন্দ্রনাথের আমলে, হৈমন্তীর বাবা অনুধাবন করেছিলেন, ” অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিবার মতন বিড়ম্বনা আর কিছু নেই।”
আর এই ২০২১’শে আমিও বিড়ম্বিত হই যখন দেখি আধুনিকা বীরঙ্গনা।
এই অতিব উচ্চবিত্তের ভিকটিম বউগুলার থেকে, আমার বাড়ির কাজের বুয়াটা, রাস্তায় মাঝে মাঝে রেইপ হওয়া গার্মেন্টসের কর্মী মেয়েটাও অনেক বেশি মাথা উঁচু করে চলে।
যারা ম্যারিটাল রেপকে সত্য বলে স্বীকার করেন তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
পর্ব-৪৬
“And for women are rights over men similar to those of men over women.”(Qur’an, 2: 228)
ভদ্রলোক ফোনে বললেন, ” ম্যাডাম, আমি নিঃসন্তান, ৯ বছরের বিয়ে। তাই আমি চাই বর্তমান স্ত্রী থাকুক। সাথে দ্বিতীয় একজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দিই। সেই গর্ভে আমার ঔরসজাত সন্তান হোক। কিন্তু আমার স্ত্রী কিছুতেই মানছেন না। তাই ওকে আপনার কাছে কাউন্সেলিং এর জন্য নিয়ে আসতে চাই।”
আমি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ” আমি বললেই আপনার স্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার পারমিশন দেবে এটা কে বলল?”
ভদ্রলোক, ” আমার মনে হয় আপনি কাউন্সেলিং করে ওকে কনভিন্স করতে পারবেন।”
আমি: ” কনভিন্স করা কিন্তু কাউন্সেলিং এর কাজ না। কাজেই এ উদ্দেশ্যে যদি আসেন, তবে শুধু কাউন্সিলারের পকেট ভারী হবে। যিনি সেশন নিচ্ছেন তার কোনো লাভ হবে না। “
ভদ্রলোক: ” আমি খুবই বিপদে পড়েছি, মানবিক দিক থেকে আমার সমস্যাটা একটু দেখুন।”
আমি: ” আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার নিজের সেশন নেয়াটাই বেশি জরুরি। স্ত্রী নয় বরং আপনিই আসুন সেশন নিতে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক একাই আসলেন; বয়স ৩৭। ভালো চাকরি করেন, ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, হাস্যজ্জল, বন্ধুবৎসল, সদালাপী একজন মানুষ।
কাউন্সেলিং টেবিলে সব সময় দেখা যায় presenting issue আর core issue ভিন্ন হয়। অর্থাৎ, মানুষ যে সমস্যার কথা বলে কাউন্সিলিংয়ের দ্বারস্থ হয়, পরবর্তীতে দেখা যায় আসল কারণ অন্য কিছু। এক্ষেত্রেও ব্যত্যয় নেই।
কথাপ্রসঙ্গে উঠে আসলো, বছরখানেক হলো অফিসের এক সহকর্মীর সাথে ভদ্রলোক রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এখন, তার প্রবল ইচ্ছা এই সহকর্মীকেই বিয়ে করা। কিন্তু স্ত্রীকে ত্যাগ করবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই ইদানিং বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি বাবা হতে চান। বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত প্রাণ।
অথচ, নতুন সংসারে যদি তিনি যাত্রা শুরু করেন, কতদিন পরে বাবা হবেন সেটা জিজ্ঞেস করলে একটু ভেবে বললেন, ” এখনও ভাবিনি, কয়েক বছর যাক। তারপর চিন্তা করব।”
ভদ্রলোকের ভাষ্যমতে, তিনি শারীরিকভাবে বাবা হতে সক্ষম ( ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষিত), মানসিকভাবে বাবা হতে ইচ্ছুক (যদিও কবে সেটার স্পেসিফিক ডেডলাইন নেই), সামাজিকভাবে পাছে লোকে কিছু বলে কিভাবে ট্যাকেল করবেন বুঝতে পারছেন না ( কাউন্সেলিং এ আসো সেটাই মূল কারণ), আর ধর্মীয়ভাবে ইসলাম তাকে ৪ বিয়ের অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
আমি বললাম: ” সেই একাধিক বিয়ে করার জন্য একাধিক শর্তও কিন্তু ইসলাম দিয়েছে। তাই না? আপনি কি সেই শর্তগুলো জানেন?”
এরপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
সুবিধাবাদী মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সেই তথ্যগুলোই ব্যবহার করবে, যেগুলো তাদের ইচ্ছা পূরণে সহায়ক। Cheating is a choice not an option.
ভদ্রলোককে বললাম, ” আপনার নিজের কাছে, কোন জায়গাটায় গিল্ট ফিলিং হচ্ছে? সেই ‘ আমার দোষ’ অনুভূতি থেকে মুক্তির জন্যই জন্যই কি স্ত্রীকে কাউন্সেলিংয়ে আনতে চাচ্ছেন? নইলে এত টাকা খরচ করে কাউন্সেলিং না করিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতেন কোন ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞের কাছে। যাতে আপনাদের সন্তান হয়। তাই না? “
ভদ্রলোক চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। মাথা নত করে থাকলেন।
পুরনো স্ত্রীকে আর পছন্দ হচ্ছে না। নতুন প্রেমের ফুল ফুটেছে। তাই পুরাতনকে এখন পথ ছেড়ে দিতে হবে, পরকীয়ার নগ্ন সত্যকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে, সন্তান জন্মদানের অক্ষমতার গ্লানিকে মাথায় নিয়ে।
আমি ভদ্রলোককে বললাম, ” মানুষ প্রেমে পড়লে শরীরে একটা হরমোন নিঃসরণ বাড়ে। আস্তে আস্তে ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে এটা কমে যায়। কাজেই, এখনই হুট করে সিদ্ধান্ত নেবেন না। অপেক্ষা করুন। সময়ের সাথে সাথে, অনুভূতিগুলো কিভাবে বদলায় একটু খেয়াল করুন। প্রয়োজনে আমরা আবার সেশনে বসব। ইসলাম অধিকার দিয়েছে, বলে ঝাপিয়ে পড়ার আগে,একটু খেয়াল করুন তো ইসলামের কয়টা নিয়ম আপনি ঠিকঠাক মতো মানেন? ভবিষ্যতে যে নতুন সহকর্মী জীবনে আসবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?”
যারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষুদ্রতায় লিপ্ত নন, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-৪৭
“আমরা অমুক জায়গা থেকে এসেছি, উনি আমার পরিবার।” ভদ্রলোক বললেন।
স্ত্রী জবুথবু হয়ে ঢুকলো পিছে পিছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম : “এতদূর থেকে?”
ভদ্রলোক : ” জ্বী। সকাল ছয়টার বাসে উঠছি।”
আমি: “আপনারা কিছু খেয়েছেন?”
স্বামী ও স্ত্রী একসাথে দম দেয়া কলের পুতুলের মতন মাথা নেড়ে: “হ, হ, কলা, বনরুটি খাইছি।”
আমি: ” চা খাবেন?”
ভদ্রলোক ” আপনারে কষ্ট দিমু না।”
আমি: ” আমি প্রতি ঘণ্টায় চা খাই। আমার সাথে খান। আমার সাথে কার কথা বলা দরকার?”
স্ত্রী: ” আমার কিছু ভালো লাগেনা। খালি মইরা যাইতে ইচ্ছা করে।”
মরা মাছের চোখ যেমন ফ্যাকাশে, কোন এক্সপ্রেশন নাই, ভদ্রমহিলার চোখ সেরকম। সম্পূর্ণ মেকানিক্যাল ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন।
আমি: ” আপনার বয়স কত?”
ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে তাকালেন, “কত হইবো?”
স্বামী: ” ধরেন এই ২৩ বছর।”
ভদ্রমহিলা তোতা পাখির মতন মুখস্তের ভঙ্গিতে, ” ২৩ বছর।”
আমি, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম: ” আমি একটু ওনার সাথে একা কথা বলতে চাই। ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। আপনি বাইরে ওয়েটিং রুমে বসতে পারেন, অথবা চাইলে ঘুরেও আসতে পারেন।”
ভদ্রলোক: ” আমি শুনছি আপনি একাই কথা কন। অসুবিধা নাই। “
ভদ্রলোক বের হয়ে গেলে আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি জানেন আমি কি কাজ করি? আপনাকে কি জোর করে এনেছে নাকি নিজের ইচ্ছায় এসেছেন?”
ভদ্রমহিলা সেই ঘষা কাঁচের মতন চোখে তোতাপাখির ভঙ্গিতে বললেন, “হ জানি হের বন্ধু বড় চাকরি করে সেই আপনার ঠিকানা দিছে। কইছে আপনি যেমন বলবেন তেমন করতে।”
আমি: “বেশ, আপনার আমার মধ্যে যা কথা হবে সেটা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে। আপনার স্বামীকে আমি কিছু বলবো না। আর যদি কথা বলে দেখেন আমাকে আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে বলবেন আমি আপনাকে আপনার কাছাকাছি অন্য কাউকে খুঁজে দেব। কেমন? আমাকে কি একটু বলবেন আপনার কি কষ্ট হয়?”
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
মেয়েটির ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন সময়ে এক ঘণ্টার নোটিশে দ্বিগুণ বয়সী ধনবান মধ্যপ্রাচ্য নিবাসী একজন দক্ষ শ্রমিকের সাথে বিয়ে হয়। মেয়েটা ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হত। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। দিন দশেক পরে স্বামী উড়াল দেয়। দু’বছর পরে আবার দেশে ফিরে। এবার মাসখানেক থাকে। যদিও স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়ার খবরটি সে মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে শুনে। তারপর বাচ্চা নিয়ে অনেক কষ্টে মেট্রিক পাশ করলেও, মেয়েটির আর পড়াশোনা হয়নি। এবার স্বামী দীর্ঘ ৪ বছর প্রবাসে থাকেন। তারপর আবারও এক মাসের ছুটি। এইভাবেই হয়তো চলত। কিন্তু প্যানডেমিকের কারণে একবারে সব গুটিয়ে মাস ছয়েক হলো স্বামী দেশে ফিরেছেন। স্বভাবতই ভদ্রলোক এখন দ্বিতীয় সন্তান চান। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের খরতাপদগ্ধ রুক্ষতার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে কোমলতার স্পর্শ চান।
কিন্তু ভদ্রলোক যেটা বুঝতে পারেন নাই, সেটি হল এই দীর্ঘ দূরত্বে স্ত্রীর জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ এসেছে বেনোজলের মতন তারুণ্যের বানভাসিতে। সেই পুরুষটি মেয়েটিকে তার আগের পক্ষের সন্তানসহ স্ত্রীর মর্যাদা দিতেও এক পায়ে রাজি। প্রয়োজনে নিজেদের নতুন সংসার জীবনে আর বাচ্চা নিবে না সেই প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি সেই সম্পর্কটিকেও ভেঙে দিয়েছে নৈতিকতা, সামাজিকতার নিয়ম রক্ষায়।
যদিও মেয়েটির পুরনো সম্পর্ক থেকে সরে এসেছে, তবুও সেই ক্ষত এখনো অবিরাম রক্তপাত ঘটায় তার মনে। মেয়েটির কাছে স্বামীর উপস্থিতি এখন ভয়ঙ্কর বিবমিষা উদ্রেককারী। না যায় বলা না যায় সহা অবস্থা। সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে সে সংসার ছাড়তে চায় না। আবার এই সংসারে তার কিছুতেই মন টেকে না। উপরন্তু দ্বিগুণ বয়সী হওয়ায় জেনারেশন গ্যাপ তো আছেই, সেই সাথে, দীর্ঘ সময় একসাথে না থাকার কারণে কোনরকমে আন্ত মানসিক সম্পর্কও দানা বাঁধেনি। বিগত ছয় মাস ধরে যখন ২৪ x৭ তাদের প্রকৃত অর্থে দাম্পত্য সম্পর্ক শুরু হলো, মেয়েটি প্রথম কিছুদিন সহ্য করলো। তারপর এক গাদা ঘুমের ওষুধ খেলো। স্বামীটি কিন্তু প্রচন্ড যত্ন করে এরপর থেকে নিয়মিত তাকে ওষুধ খাওয়ান, ছয়দিন ভালো থাকলে সাত দিনের দিন প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। মেয়েটি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে আড়কাঠে ঝুলে। এবার স্বামীটি ভয় পেলেন। যত্ন আরো বাড়লো। সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে দম্পতিটি নিয়মিত সহবাস করত যদিও মানসিক সহবাস ছিল না।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। যখন ডানাভাঙ্গা পাখি একটা খাঁচায় আবদ্ধ থাকে তখন তার কেমন লাগে ভেবে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই চোখে মুখে সেই অসহায়ত্বর করুণ অদৃশ্য ছাপ।
আমি ভদ্র লোককে ডেকে বললাম,
” আপনার স্ত্রীর কিছুদিন সময় লাগবে। ওকে কোন কাজে ব্যস্ত করেন যেখানে সে আত্মনির্ভর হবে। সেই সাথে আপনার ২৩ বছরের সেই মনটি কেমন ছিল সেটা একটু জাগিয়ে তুলুন। তখন আপনার প্রেম করতে ইচ্ছে করত না? সেই প্রেমটি এখন এই স্ত্রীর সাথে করুন। ওনাকে স্ত্রী মনে না করে, একবার কি প্রেমিকা ভাবা যায় না? তবে এই মুহূর্তে সন্তান না নেওয়াই ভালো। সময় আছে। দুজনের মধ্যে একটা যোগাযোগের সেতু তৈরি হোক। তারপরেরটা তারপর দেখা যাবে।”
ভদ্রলোক লাজুক হাসলেন।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে আপনার সাথে আমার কিছু সাইকোথেরাপির কাজ আছে। নিয়মিত সেশন লাগবে। আপনাকে আমার চেম্বারে আসতে হবে। এতদুর থেকে সেটা কি সম্ভব? নাকি আমি অন্য কাউকে ঠিক করে দেব?”
স্ত্রী কিছু বলে ওঠার আগেই আগবাড়িয়ে স্বামী বললেন, ” ওকে আমি নিয়ে আসবো, সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। ওর জন্য যা করতে লাগে আপনার দিকেরটা আপনি করেন।”
মেয়েটার চোখে পানি না কৃতজ্ঞতা কোনটা চিকচিক করে উঠলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। যাওয়ার আগে বলল, ” আমি ভাল হব তো?”
আমি বললাম, ” যেটুকু কমতি থাকবে ভালো হতে, ভালো থাকতে, সেগুলো পূরণ করার মানুষ তো আমরা আছি আপনার পাশে, আপনার জন্য। হৃদয়কে প্রাধান্য দিতে গেলে দায়িত্ব নিতে শিখতে হয়। নিজের দায়িত্ব নেবার জার্নিটা তো শুরু করুন। “
যারা জীবনসঙ্গীর কষ্টগুলোকে নিজের কষ্ট মনে করে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-৪৮
ভদ্রমহিলার বয়স ৫৫। আমার চেম্বারে মেয়েজামাই দুজনকে একসাথে নিয়ে ঢুকেই বললেন “এই যে দুইজনকে এনে দিলাম, কার কি কাউন্সেলিং লাগবে দেখুন। যার যত দিন লাগে কাউন্সেলিং চলুক আমার আপত্তি নেই। কিন্তু রোজকার এই অশান্তি বন্ধ হোক।”
পরিবারটির সবাই ডাক্তার। বাবা-মা দুজনই মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। হুলুস্থুল প্র্যাকটিস। মেয়ে জামাই দুজনেরই বিসিএস হয়ে এখন ট্রেনিং করছেন এফসিপিএস এর। ঝলমলে ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার।
আমি খুব অবাক হয়ে তিন জনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আমি কিন্তু কাপল কাউন্সেলিংএ প্রথমে প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা সেশনে কথা বলি পরে প্রয়োজন বোধ করলে একসাথে দুজনকে নিয়ে বসি।”
ভদ্রমহিলা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ” আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট অলরেডি বলছে একথা, কিন্তু আপনি আগে আমার কাছ থেকে শুনেন।”
আমি বললাম, “সমস্যা আপনার মেয়ের দাম্পত্য কলহের তাইতো?”
ভদ্রমহিলা: ” হ্যাঁ, আমার মেয়ে জামাইয়ের।”
আমি: ” আমি দম্পতির সাথে কথা বলবো। আপনি তো এই দম্পতির স্বামী বা স্ত্রী নন। তাহলে আপনার কাছে কেন শুনবো?”
ভদ্রমহিলা ঝাঁঝালো কন্ঠে: ” কারন ওরা বুঝিয়ে বলতে পারবেনা।”
আমি: ” ওনাদের বয়স কত?”
ভদ্রমহিলা: ” আমার মেয়ের ৩৩, জামাইয়ের ৩৫।”
আমি: ” একজন ৩৩ ও ৩৫ বছরের মানুষ আরেকজন মানুষের ডেথ ডিক্লেয়ার করতে পারে, আর নিজেদের সমস্যা বুঝিয়ে বলতে পারবে না? তার জন্য আপনাকে উকিল ধরতে হবে?”
ভদ্রমহিলা তীব্র কন্ঠে, ” আপনি না শুনলে বুঝবেন কি করে?”
আমি, ” একদম ঠিক বলেছেন, কিন্তু সেই শোনাটা আমি স্বামী-স্ত্রী মুখ থেকে শুনতে চাই। কোন তৃতীয় পক্ষর না।”
ভদ্রমহিলা, ” আমি মা, ওদের সমস্ত সাপোর্ট আমি দেই। আমি কোন বাইরের মানুষ বা তৃতীয় পক্ষ নই। আমি অন্য মা’দের মতো না।”
আমি বললাম, ” প্রত্যেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটা বাউন্ডারি থাকে। এই বাউন্ডারি যারাই ক্রস করে তারাই তৃতীয় পক্ষ।”
ভদ্রমহিলা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তার চোখে x-men টাইপ অস্ত্র থাকলে অবিলম্বে ভস্মীভূত হয়ে যেতাম।
আমি মধুর হেসে বললাম, “মেয়ে জামাই আপনারা দুজনে একটু বাইরে বসুন। আমি আপনাদের মায়ের সাথে কথা বলতে চাই একা।”
মেয়ে জামাই প্রথমে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। তারপর আমার দিকে। শাশুড়ি এখনো মুখ তোম্বা করে বসে আছেন। তার অ্যান্টেনায় ক্যাচ হয় নাই বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে। আমি ইশারা করলাম বের হয়ে যেতে। একটু হতভম্ব ভাবেই মেয়ে জামাই দুজনে বের হয়ে গেলেন।
আমি ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে বললাম, ” আপনি বলছেন আপনি অন্য বাবা-মার থেকে অনেক বেশি সাপোর্ট করেন। কি কি করেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য?”
ভদ্রমহিলা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ” কি করি না বলেন, টাকা পয়সা লাগলে দেওয়া তো আছেই, এমন কি যে দুইজনের ঢাকার বাইরে বিসিএসের পোস্টিং প্রতিদিন সকালে কি রান্না করবে, কি খাবে, কখন বুয়া কাপড় শুকাতে দিল কখন তুলল সব আমাকে অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে বলতে হয়। এত বলি এভাবে করো, সেভাবে করো, কিছুতেই শুনে না দুইজন। আর কাহাতক বলা যায়। আমার নিজেরই এখন অসহ্য লাগে। নিজেকে সামলাতে পারে না, এখন আবার বাচ্চা নেওয়ার জন্য ঝামেলা শুরু করছে। আমি পারব না ওদের বাচ্চা সামলাতে।”
আমি বললাম, ” আপনার কোন চিন্তাটা, আপনাকে মেয়ের সংসারে ডিকটেট করতে বলে?”
ভদ্রমহিলা ফোঁস করে উঠলেন, “আমি ডিকটেট করি?”
আমি, ” জ্বী। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, রাষ্ট্র যাদেরকে বিয়ে করার মনোদৈহিক সনদ দিয়েছে, শিক্ষা যাদেরকে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার সনদ দিয়েছে, post-graduation এ পড়ছেন তারা আর যাই করুক বাড়িতে কি রান্না হবে, কখন কাপড় তুলতে হবে এটুকু করে নিতে পারবেন। কিন্তু কথা হল এটুকু করে নেওয়ার জন্য তাদেরকে সেই স্পেসটা দিতে হবে। আমি বুঝতে পারছি আপনি মা। আপনি আপনার সন্তানের জন্য বেস্টটাই চাইবেন এবং সব সময় দেয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো ওদের কাজগুলো যদি ওদেরকে আপনি করতে না দেন তবে ওরা কিভাবে শিখবে? ছোটবেলায় আপনার মেয়েকে কতবার আপনি হ্যান্ড রাইটিং প্রাক্টিস শিখিয়েছিলেন। তখন কি মেয়েকে না দিয়ে নিজে নিজে লিখতেন?”
ভদ্রমহিলা চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন এত কষ্ট করে বড় করা আমার মেয়েকে আমি ছেড়ে দেবো? সারা জীবন ওর ভালো-মন্দ কি হবে আমি বুঝি এসেছি। সেভাবে ওর ভালোটাই হয়েছে। আপনার কথায় আমি আমার বাচ্চাকে ছাড়তে পারবো না। আর আপনিই বা কে এই কথা বলার?”
আমি, ” একদম ঠিক, আপনার বাচ্চাকে আপনার থেকে ভালো পৃথিবীতে কেউ বাসে না। আপনার থেকে বেশি কষ্ট, বেশি সেক্রিফাইস পৃথিবীর কোন মানুষ করেনি আপনার মেয়ের জন্য। আমি দেড় ঘন্টার সেশনে কোন সমাধান দিতে পারব না। ইনফ্যাক্ট সমাধান দেয়াটা কাউন্সিলিংয়ের কাজ ও নয়। আমাকে পছন্দ না করলে আপনি অন্য কাউন্সিলরের কাছে যাবেন। আমি শুধু আপনাকে একটু খেয়াল করতে বলবো, স্বামী-স্ত্রীর এই আন্তঃসম্পর্কের দ্বন্দ্বে আপনার কোন আচরণটা কনফ্লিক্ট তৈরিতে সাহায্য করছে?”
ভদ্রমহিলা থম মেরে গেলেন। চা আসলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমি চা খাচ্ছি। ভদ্রমহিলা সামনের চা ঠান্ডা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” আপনি অসম্ভব ইন্টেলেকচুয়াল একজন মানুষ। এত বড় একটা পদে কাজ করছেন। আপনার সেই ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গাটিকে সম্মান দেখিয়ে নিরপেক্ষভাবে একটু ভাবুন তো, ছোট্ট একটা বীজ ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে মহীরুহ হয়। যত বেশি ঝড়ঝাপটা তত শিকড় মাটির বুকে আরো গভীরে ঢুকে যায়, তাই না? আপনার উদ্দেশ্য সন্তানের মঙ্গল। আজ বাদে কাল যখন আপনি পৃথিবীতে থাকবেন না আপনার সন্তান যদি এই কাজগুলো এখন যদি নিজে না করে তবে সে কিভাবে তখন করবে? কাজই ওদেরকে ওদের মতন ছেড়ে দিন। ওদেরকে ওদের মতো শিখতে দিন। ওদের পার্সোনাল লাইফে স্পেস দিন। একটা ৩৩ আর ৩৫ বছরের দম্পতিকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন, কখন তারা সন্তান নেবেন; কখন তাদের কাপড় শুকাতে দেবেন। আপনার সন্তানের দায়িত্ব যেমন আপনি নিচ্ছেন, তাদের সন্তানের দায়িত্ব তাদেরকে নিতে দিন। তাদেরকেও বুঝতে দিন, কত ধানে কত চাল। কিন্তু আপনার ভালোবাসার কারণে যখন আপনি একটা দম্পতির পার্সোনাল স্পেসের বাউন্ডারিটা ক্রস করবেন, তখন আপনার জন্যই আপনার অজান্তেই তাদের ঝগড়া লাগবে। আপনি কি জানেন আপনার এই খবরদারির জন্য আপনার মেয়েকে কখন, কিভাবে, কতটুকু এডজাস্ট করতে হচ্ছে? আপনার জামাইকে কতটুকু বিরক্ত হতে হয়? মেয়ের শাশুড়ি নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে কথা বলে না। আপনার ভালোবাসা আপনার মেয়ের জন্য সংসার জীবন টাকে আরো কষ্টকর করে তুলছে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ আপনাদের এই আমার চেম্বারে আসা। আমি তো বলব আপনার মেয়ে জামাই দুজনেই অতিরিক্ত ভদ্র বিধায় আপনার সাথে আজকে আমার এখানে এসেছেন।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
প্রত্যেকটা দম্পতি একটি ইউনিট। এখানকার মেম্বার শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী। একটা পরিবার হলো এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটের সমন্বয়। বৃহত্তর পরিবারে বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি ভাই-বোন সবাই থাকেন। আমি শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ, জা, শালা, শালী, দুলাভাই, আত্মীয়, প্রতিবেশী যাই হই না কেন যেকোনো দম্পতির ব্যক্তিগত স্পেসে ঢুকে পড়াটা অভদ্রতা। তাদের ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সেটা আদিরসাত্মক যৌন মিলন সংক্রান্ত অথবা সন্তান কবে নেবে ইত্যাদি যেকোনো কিছুই জিজ্ঞেস করাটা চূড়ান্ত অভদ্রতা। একটা নতুন দাম্পত্য সম্পর্ক যখন তৈরি হয়, তখন দুটো মানুষ অলরেডি নিজেরাই এডজাস্টমেন্ট ক্রাইসিসে ভোগেন। এমনকি যদি বিয়ের আগে তাদের প্রেমও থাকে, তারপরও দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এক নয়। কাজেই মানুষ দুটিকে নিজেদের সম্পর্কে থিতু হওয়ার সময় দিন। আপনার জ্ঞান এখানে ঝাড়বেন না। একটা বাউন্ডারি থাকতে হবে। কারণ দেখা যায় দাম্পত্য কলহে পরিবারের ইনভলভমেন্ট ঝামেলা আরো বাড়ায় বই কমায় না। কারণ ছেলেপক্ষ ছেলের দিকে, মেয়ে পক্ষ মেয়ের দিকে ঝোল টেনে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। স্বামী ও স্ত্রী নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করুন। নিজের বাপ মা ভাই বোনকে সমস্যার সমাধানে স্পেশালিস্ট হিসেবে আনার দরকার নেই। নিজেরা না পারলে কাউন্সেলিং এর সাহায্য নিন। কাউন্সিলর নিরপেক্ষ থাকবেন।
যেসব দম্পতি নিজেদের বাউন্ডারি নিজেরাই সসম্মানে মেইন্টেন করেন, নিজেরাই ঠিক করেন পারস্পরিক সহমর্মিতায় পূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে উভয়ের পরিবারকে কতটুকু জানাবেন, কতটুকু জানাবেন না সেসব দম্পতির প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-৪৯
পর্ব-৫০
“Brains, like hearts, go where they are appreciated.”
–Robert McNamara, Former American Secretary of Defense.
কাউন্সেলিং টেবিলের গল্পর ১ম থেকে ৪৯তম পর্বের লেখাগুলো ছিল আমার চেম্বারে বিভিন্ন সেশনে আসা অন্যের সত্য ঘটনাবলি। যেগুলো তাদের পারমিশন নিয়ে লেখা।
আমি ভেবেছিলাম ৫০তম পর্বটা হবে একটা বিশেষ সংখ্যা ক্রোড়পত্রের মতন। যেখানে অন্যের গল্প না বলে অন্যদেরকে নিজের একটা অনুভুতির গল্প বলবো। তাই উপযুক্ত বিষয়বস্তুর সন্ধানে ছিলাম। আজ সে ঘাটতি পূর্ণ হয়েছে।
আমি ব্যক্তিগত জীবনে খুব সাধারন মাপের একজন বিশেষত্বহীন মানুষ। রাস্তাঘাটে আপনাদের পাশে এমন মানুষ অহরহ ফুটপাতে হাঁটে, বাসে ট্রেনে সহযাত্রী হয়, দোকানে কেনা কাটার লাইনে দাঁড়ায়। এরা একটি সংখ্যা হয়, এদের কোন নাম থাকে না।
এই অতি সাধারন আমি’কে আজ অসাধারণ করে তুলল একটা পেইন্টিং। মানুষের বেসিক ফিলিং খতিয়ে দেখতে দেখতে সবসময় সবচেয়ে বাধ্যতামূলক ঘাটতি পাই হ্যাপিনেস বা আনন্দর।
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
আনন্দ কখনো আমার চেম্বারে আসে না। কিন্তু আজকে আনন্দ এসেছিল একটা ছবির রূপ নিয়ে। যেই ছবির ইলেকট্রিকের তারগুলো ছিল মানুষের মনোজগতের জটিলতা। আর মিউজিক্যাল নোটেশনগুলো ছিল অনুভূতি সম্বলিত নিউরনের প্রতিচ্ছবি। আমার এ পর্যন্ত পাওয়া চিকিৎসক, কাউন্সেলির ও সাইকোথেরাপির কাজের সব থেকে বড় স্বীকৃতি এই আনন্দ চিত্র।
আনন্দ ভাগ করে নিতে হয়। আজকে কাউন্সেলিং টেবিলের গল্পের ৫০তম বিশেষ পর্বের আনন্দ ভাগ করে নিলাম ফিনিক্স
PHOENIX
পরিবারের সবার সাথে।যারা অন্যের জন্য আনন্দ তৈরি করতে পারে তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।