কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
পর্ব-৩১
ভদ্রমহিলার বয়স ২৭, সারাদিন ব্যস্ত থাকেন টিকটক বানানো নিয়ে। দুই বাচ্চা কি খেলো, কখন ঘুমালো, বাচ্চার বাবা কই গেলো, কাজের মেয়ে বাসা থেকে কি বাইরে নিয়ে বেচে দিল, ভদ্রমহিলার কিছুই খেয়াল থাকে না। ভিডিও বানাতে কাজে লাগে এরকম লাইট, স্ট্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস কিনে এনেছেন। গেস্ট রুমটিকে মোটামুটি স্টুডিও বানিয়ে ফেলেছেন।
বড় বাচ্চাটির পাঁচ বছর, সেটি বাথটাবের পানিতে ডুবে যায় গোসল করার সময় মায়ের অমনোযোগিতায়। এর আগে এরকম আরও দুবার হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে কাউন্সিলিং এ এনেছেন।
ভদ্রলোক বলেন, ” আমার স্ত্রীকে তো সারাদিন কোন কাজ করতে হয় না, দুটো কাজের মহিলা আছে। ও যে বাচচাদের বা আমাকে ভালোবাসে না তা কিন্তু না। সমস্যা হলো সারাদিন কি একটা অদ্ভুত নেশার মধ্যে থাকে। পরে আমি রাগ করে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার পরে ও দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। “
ভদ্রমহিলা শুরুতেই বললেন, ” আমি আসলেই কোনো কাজের না, না ভালো মা, না ভালো বউ। সব সময় অস্থির লাগে, মেজাজ খিটখিটে করে, ঘুম তো একদমই না।”
ভদ্রমহিলার মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। সেশনের শুরুতে, ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও কিছুক্ষণ পর তাঁর মধ্যে অস্থিরতা খেয়াল করতে থাকি। এক পর্যায়ে তিনি আমার ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চান। পাসওয়ার্ড দেবার সাথে সাথে অস্থিরভাবে অনলাইনে ঢুকে যান। আস্তে আস্তে ভদ্রমহিলার মুখোভঙ্গি শিথিল হতে থাকে।
তারপর কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ইদানিং অনলাইন আসক্তি, ড্রাগ অ্যাডিকশন এর মতই মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। যত বেশি অনলাইনে থাকবেন তত আরও বেশি সময় ধরে অনলাইনে থাকার চাহিদা তৈরি হবে। কিছুক্ষণ পর পর বারবার কোথায় কি আপডেট দেখতে ইচ্ছে হবে। এতে মস্তিষ্কের উপরে তীব্র প্রভাব পড়ে।
কি হয়?
আমাদের ব্রেইনে একটা রিওয়ার্ড সেন্টার আছে। অনলাইন ওই জায়গাটাকে উত্তেজিত করে। ফলে কিছু কেমিক্যাল নি:শ্রিত হয় মস্তিষ্কে। আস্তে আস্তে যত বেশি অনলাইনে থাকবো, ততবেশি কেমিক্যাল বেরোবে; এক পর্যায়ে আসক্তিতে রূপ নেবে। ঠিক ঘুমের ওষুধের মতন, যত ব্যবহার করবো ততই ডোজ বাড়বে।
ব্রেইন আমরণ নতুন নতুন অভ্যাস তৈরি করে। এই নতুন অভ্যাস তৈরির হাতে ধরেই শুরু হয় আসক্তি। ফলে যত বেশি অনলাইনে থাকবো তত বেশি মস্তিষ্ক আরো চাইবে। ঠিক যেভাবে সেটা মদ, তামাক বা মাদকের জন্য মস্তিস্ক উত্তেজিত হয়।
আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এই কেমিক্যাল যেগুলী ব্রেইন থেকে রিলিজ হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এদের মাত্রা যখন রক্ত কমে যাচ্ছে, তখন কিন্তু মানুষটি আবার বিষণ্ণ বোধ করছে, দুশ্চিন্তা বোধ করছেন। এই খারাপ লাগাটা থেকে বের হওয়ার জন্য আবার তিনি অনলাইনে ঢুকছেন। একটি দূষিত চক্র ।
মুক্তির উপায় কি?
আমাদের ব্রেইনটা খুব মজার একটা জিনিস। আমি মনে করি মানুষের মস্তিষ্ক খুব পজিটিভ মানসিকতার একটা জিনিস। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি প্রতিদিন জিমে যাচ্ছেন। নিয়ম করে ব্যায়াম করছেন। তাহলে কি হবে? কিছুদিন পর দেখা যাবে আপনারও সিক্স প্যাক হচ্ছে, বডিবিল্ড হচ্ছে। তার মানে কি? মানে আপনার muscle develop হচ্ছে. পেশি শক্ত হচ্ছে। তার মানে যত পেশির ব্যবহার বাড়াবো বেশি তত শক্ত হবে। এটাকে বলা হয়, use it or lose it. ঠিক এই পদ্ধতি আমরা ব্রেইনের সাথে ব্যবহার করব।
আপনি যত অনলাইনে থাকা কমাবেন তত দ্রুত এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাবেন।
এই মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে উত্তেজিত করে ডোপামিন নামের একটি কেমিক্যাল। তাহলে আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে অনলাইনের বদলে বিকল্প আর কি আমরা ব্রেইনের হাতে তুলে দিতে পারি যেটা ডোপামিন রিলিজ বাড়াবে।
না আমি যদি বিকল্প কিছু তুলে না দেই, ওই চাহিদাটা তো ব্রেইনের থেকেই যাবে।
ডোপামিন ( reward chemical ) তৈরি বাড়ায়:
*একটা কাজ ঠিকমতো শেষ করার আত্মতৃপ্তি
*সেল্ফ কেয়ার
*এক্সারসাইজ
*মিউজিক শোনা
*কৃতজ্ঞতাবোধ
*ছোট ছোট কাজগুলোতে সফল হলে সেলিব্রেশন ( সেলিব্রেট করলে আমাকে ডাকতে ভুলবেন না যদি এই কথাগুলো কাজে লাগে।)
সাথে আরও কিছু পদ্ধতি আছে। কাজেই অনলাইন আসক্তি চিহ্নিত করুন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
এই প্যানডেমিকের সময় এটা মারাত্মক নিরব মহামারী রূপ ধারণ করেছে।