Phoenix

কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প

পর্ব-৩১

ভদ্রমহিলার বয়স ২৭, সারাদিন ব্যস্ত থাকেন টিকটক বানানো নিয়ে। দুই বাচ্চা কি খেলো, কখন ঘুমালো, বাচ্চার বাবা কই গেলো, কাজের মেয়ে বাসা থেকে কি বাইরে নিয়ে বেচে দিল, ভদ্রমহিলার কিছুই খেয়াল থাকে না। ভিডিও বানাতে কাজে লাগে এরকম লাইট, স্ট্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস কিনে এনেছেন। গেস্ট রুমটিকে মোটামুটি স্টুডিও বানিয়ে ফেলেছেন।

বড় বাচ্চাটির পাঁচ বছর, সেটি বাথটাবের পানিতে ডুবে যায় গোসল করার সময় মায়ের অমনোযোগিতায়। এর আগে এরকম আরও দুবার হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে কাউন্সিলিং এ এনেছেন।

ভদ্রলোক বলেন, ” আমার স্ত্রীকে তো সারাদিন কোন কাজ করতে হয় না, দুটো কাজের মহিলা আছে। ও যে বাচচাদের বা আমাকে ভালোবাসে না তা কিন্তু না। সমস্যা হলো সারাদিন কি একটা অদ্ভুত নেশার মধ্যে থাকে। পরে আমি রাগ করে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার পরে ও দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। “

ভদ্রমহিলা শুরুতেই বললেন, ” আমি আসলেই কোনো কাজের না, না ভালো মা, না ভালো বউ। সব সময় অস্থির লাগে, মেজাজ খিটখিটে করে, ঘুম তো একদমই না।”

ভদ্রমহিলার মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। সেশনের শুরুতে, ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও কিছুক্ষণ পর তাঁর মধ্যে অস্থিরতা খেয়াল করতে থাকি। এক পর্যায়ে তিনি আমার ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চান। পাসওয়ার্ড দেবার সাথে সাথে অস্থিরভাবে অনলাইনে ঢুকে যান। আস্তে আস্তে ভদ্রমহিলার মুখোভঙ্গি শিথিল হতে থাকে।

তারপর কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।

ইদানিং অনলাইন আসক্তি, ড্রাগ অ্যাডিকশন এর মতই মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। যত বেশি অনলাইনে থাকবেন তত আরও বেশি সময় ধরে অনলাইনে থাকার চাহিদা তৈরি হবে। কিছুক্ষণ পর পর বারবার কোথায় কি আপডেট দেখতে ইচ্ছে হবে। এতে মস্তিষ্কের উপরে তীব্র প্রভাব পড়ে।

কি হয়?

আমাদের ব্রেইনে একটা রিওয়ার্ড সেন্টার আছে। অনলাইন ওই জায়গাটাকে উত্তেজিত করে। ফলে কিছু কেমিক্যাল নি:শ্রিত হয় মস্তিষ্কে। আস্তে আস্তে যত বেশি অনলাইনে থাকবো, ততবেশি কেমিক্যাল বেরোবে; এক পর্যায়ে আসক্তিতে রূপ নেবে। ঠিক ঘুমের ওষুধের মতন, যত ব্যবহার করবো ততই ডোজ বাড়বে।

ব্রেইন আমরণ নতুন নতুন অভ্যাস তৈরি করে। এই নতুন অভ্যাস তৈরির হাতে ধরেই শুরু হয় আসক্তি। ফলে যত বেশি অনলাইনে থাকবো তত বেশি মস্তিষ্ক আরো চাইবে। ঠিক যেভাবে সেটা মদ, তামাক বা মাদকের জন্য মস্তিস্ক উত্তেজিত হয়।

আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এই কেমিক্যাল যেগুলী ব্রেইন থেকে রিলিজ হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এদের মাত্রা যখন রক্ত কমে যাচ্ছে, তখন কিন্তু মানুষটি আবার বিষণ্ণ বোধ করছে, দুশ্চিন্তা বোধ করছেন। এই খারাপ লাগাটা থেকে বের হওয়ার জন্য আবার তিনি অনলাইনে ঢুকছেন। একটি দূষিত চক্র ।

মুক্তির উপায় কি?

আমাদের ব্রেইনটা খুব মজার একটা জিনিস। আমি মনে করি মানুষের মস্তিষ্ক খুব পজিটিভ মানসিকতার একটা জিনিস। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি প্রতিদিন জিমে যাচ্ছেন। নিয়ম করে ব্যায়াম করছেন। তাহলে কি হবে? কিছুদিন পর দেখা যাবে আপনারও সিক্স প্যাক হচ্ছে, বডিবিল্ড হচ্ছে। তার মানে কি? মানে আপনার muscle develop হচ্ছে. পেশি শক্ত হচ্ছে। তার মানে যত পেশির ব্যবহার বাড়াবো বেশি তত শক্ত হবে। এটাকে বলা হয়, use it or lose it. ঠিক এই পদ্ধতি আমরা ব্রেইনের সাথে ব্যবহার করব।

আপনি যত অনলাইনে থাকা কমাবেন তত দ্রুত এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাবেন।

এই মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে উত্তেজিত করে ডোপামিন নামের একটি কেমিক্যাল। তাহলে আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে অনলাইনের বদলে বিকল্প আর কি আমরা ব্রেইনের হাতে তুলে দিতে পারি যেটা ডোপামিন রিলিজ বাড়াবে।

না আমি যদি বিকল্প কিছু তুলে না দেই, ওই চাহিদাটা তো ব্রেইনের থেকেই যাবে।

ডোপামিন  ( reward chemical ) তৈরি বাড়ায়:

*একটা কাজ ঠিকমতো শেষ করার আত্মতৃপ্তি

*সেল্ফ কেয়ার

*এক্সারসাইজ

*মিউজিক শোনা

*কৃতজ্ঞতাবোধ

 *ছোট ছোট কাজগুলোতে সফল হলে সেলিব্রেশন ( সেলিব্রেট করলে আমাকে ডাকতে ভুলবেন না যদি এই কথাগুলো কাজে লাগে।)

সাথে আরও কিছু পদ্ধতি আছে। কাজেই অনলাইন আসক্তি চিহ্নিত করুন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।

এই প্যানডেমিকের সময় এটা মারাত্মক নিরব মহামারী রূপ ধারণ করেছে।

 

পর্ব-৩২

মেয়েটি আমাকে বলল,” আমার মনে হয় আমি আলো বাতাসহীন বদ্ধ একটা ঘরের মধ্যে আটকে আছি। নিজেকে জেলবন্দি লাগে। ভাবতে পারেন আমি, আমার দুধের বাচ্চাটাকে ভয় পাই। মাঝে মাঝে মনে হয় বাচ্চাটাকে খুন করে ফেলি। সেলফ হার্ম করি। একবার তো গলায় স্কার্ফ বেঁধে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। বাচ্চাটা তখন খুব জোরে জোরে কাঁদছিল। এই কান্নার শব্দে আমি হুশ ফিরে পাই। ইদানিং প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ভুগি, রীতিমতো হাত-পা কাঁপতে থাকে, ভয়ে অস্থির হয়ে যাই, সারা শরীর ঘেমে যায়, প্রচন্ড বুক ধক ধক করতে থাকে, মনে হয় হৃদপিণ্ডটা বের হয়ে আসবে।”
মেয়েটির মা হওয়ার পর থেকেই এই সমস্যার শুরু হয়েছে। সিজারিয়ান বেবি। আগে কিন্তু চমৎকার চাকরি করতো। নিজেই ড্রাইভ করে অফিসে যেত। এখন বাসা থেকে বেরও হতে পারে না। কখনো কাঁদছে, কখনো না খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এক দিকে তাকিয়ে বসে আছে। একবার তো হাজবেন্ডের গায়েও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। হাসবেন্ড উপায় না দেখে এক বন্ধুর পরামর্শে আমার সাথে যোগাযোগ করেন।
তারপর সেই কাউন্সিলের টেবিলের গল্প।
ভদ্রমহিলা আসলে ভুগছিলেন পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনে। আদর করে কেউ কেউ একে বলে ‘বেবি ব্লুজ’। সন্তান হওয়ার পরে নানারকম হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে এমনটা হতে পারে। আবার নতুন মা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না নতুন পরিস্থিতিতে, হয়ত ঠিকমতন পারিবারিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না, ইত্যাদি কারণেও কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি এই সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে পারেন।
লক্ষণগুলি সামান্য বা মধ্যম কিংবা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। নতুন মা ধীরে ধীরে প্রচন্ড বিষন্নতা, অস্থিরতা, ভয়, হতাশা, ক্ষুধামন্দা, নিজেকে আলাদা করে ফেলা, প্রচন্ড রাগ, খিটখিটে মেজাজ, প্যানিক অ্যাটাক, সুস্থ ভাবে চিন্তা করা, অনিদ্রা, মুডসুইং, মৃত্যুচিন্তা ইত্যাদির বেড়া ডিঙিয়ে আত্মহত্যা বা খুনের পর্যন্ত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।
আমি বললাম, ” ওনাকে, আরো আগেই আনা উচিত ছিল। যখন তার বিষন্নতা দু সপ্তাহের বেশি ধরে যাচ্ছে না, দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে, তিনি বাচ্চার যত্ন ও ঠিকমতো নিতে পারছেন না, এমনকি সাধারণ কাজগুলো করতে ও তার কঠিন মনে হচ্ছে, এবং তিনি নিজেকে বা বাচ্চার ক্ষতি করার কথা হঠাৎ হঠাৎ তার মাথায় আসছে।”
সাইকোথেরাপি এই ক্ষেত্রে চমৎকার কাজ করে। প্রয়োজনে ঔষধের সাহায্য নেয়া যায়। সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন হাসবেন্ড এবং পারিবারিক সহযোগিতার হাত। কত হাজার হাজার মা’ যে এই বিভীষিকায় এখনো ভুগছেন এবং পরিবার থেকে ন্যূনতম সাহায্যটিও পাচ্ছেন না, ভাবতেও ভয় লাগে। কাজেই প্রসব পরবর্তী মা’দেরকে বিচারকের দৃষ্টিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নয়, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে দেখুন। কে জানে তিনি বেবি ব্লুজে ভুগছেন কিনা?
যারা গর্ভবতী এবং গর্ভ-পরবর্তী মা কে সাহায্য করেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

পর্ব-৩৩

১১ বছরের সম্পর্ক। বিয়ের দু’মাসের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে গেছে দুবছর আগে। ইদানিং বাসা থেকে শুরু হয়েছে সাংঘাতিকভাবে পাত্র দেখা। কারণ মেয়েটির বয়স ৩০ হয়ে যাচ্ছে জানুয়ারিতেই।
মায়ের ধারণা এরপরে আর এই ডিভোর্সি মেয়ের জন্য ভবিষ্যতে সুপাত্র পাওয়া যাবে না। বয়স্ক মেয়ে কে আর বিয়ে করবে? তাই বাছাবাছি না করে যা পাওয়া যায় তাই আলহামদুলিল্লাহ। ঘটক ধরেছেন মোটা টাকা অগ্রিম দিয়ে। বিয়ে হয়ে গেলে আরো তিন গুণ দেবেন এই চুক্তিতে। প্রতি পাত্র দেখায়, ঘটক ২০০০ টাকা করে নেয়।
এখন প্রতি শুক্রবারে মেয়েটির নতুন ডিউটি হলো সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসা। স্বাভাবিকভাবেই দোজবর বা বিপত্নীক পাত্র আসে; চল্লিশোর্ধই বেশি। তাদের তীর্যক দৃষ্টি শুধু মেয়েটির বাবার সম্পত্তি নয়, মেয়েটির দেহ বল্লরীও মাপে। এক অব্যক্ত বেদনা, অকথ্য অপমানের বোঝা নিয়ে অধিকাংশ দেখাদেখির পর্ব শেষ হয়ে।
মেয়েটি যতই মাকে বলে, “আমি এখনও রেডি না নতুন সম্পর্কে জড়াতে, আমার এখনো সময় লাগবে সেরে উঠতে।”
মা ততই বলেন, “এভাবেই সবাই মানিয়ে নেয়।”
মেয়েটি করুন মুখে আমাকে বলছে, “বিয়ে হলে কি সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,” তোমার বাবা-মার মধ্যে সম্পর্ক কি খারাপ?”
এর সূত্র ধরেই জানা গেল, মেয়েটির বাবা মার মধ্যে প্রচণ্ড সম্পর্ক খারাপ। মায়ের বিলিভ সিস্টেমের ধারণা হচ্ছে,
১. যে সহে সে রহে।
২. ভালো মেয়েদের ডিভোর্স হয় না।
৩. সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধু মেয়েদের।
৪. ভালো মেয়েরা প্রেম করে বিয়ে করে না।
৫. জীবনে বিয়ে একবারই হয়।
৬. মেয়েদের জীবনে বিয়েটাই আসল।
৭. মেয়েদের সংসারটাই মুখ্য।
৮. পুরুষ মানুষের দোষ থাকতেই পারে, তাকে শুধরে নেয়ার দায়িত্ব মেয়েদের।
যার কারণে এখন পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, মানসিক চাপ নিতে নিতে আর না পেরে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন। সবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। সবাই জানে তিনি প্রচণ্ড খিটখিটে, কারো কথা না শোনা একজন মানুষ। অথচ মায়ের এই বাইরের রাগের ভেতরে যে কতটুকু অসহায়ত্ব লুকিয়ে আছে সেটা সাধারণ চোখে কেউ বুঝতে পারে না। এমনকি ভদ্রমহিলা নিজেও সচেতনভাবে সেটা ভুলে যাচ্ছেন। নিজের দুঃখের অনুভূতি প্রকাশ করছেন রাগ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীরা এই বিলিফ সিস্টেম নিয়েই মরিয়া প্রমাণ করিতো, যে তাহারা মরে নাই।
রবীন্দ্রনাথের কাল পার হয়ে আধুনিক যুগের এই মা তাই দিনশেষে বলছেন, “কেউ আমাকে বোঝেনা। যাদের জন্য এত কিছু করলাম তারাও না। “
অবচেতন মন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা দিয়ে বিভিন্ন সিগন্যাল দিতে চেষ্টা করেছে ভদ্রমহিলা কে। আসলে মেয়ে না ভদ্রমহিলা দরকার হচ্ছে সাইকোথেরাপি। কিন্তু ভদ্রমহিলা রাগের মুখোশটা এত তীব্রভাবে পরে আছেন, যে উনি ভুলে গেছেন ওনার আসল মুখে দুঃখের ছায়া খেলা করছে।
তিনি ভুলে গেছেন, ” সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে, গুনবানপতি যদি থাকে তার সনে ।” তাই একক দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে, আজীবন কষ্ট পেয়েছেন।
নিজে যে অদৃশ্য দহনে কুল কাঠের চিতায় জ্বলছেন, একটা মিস ম্যাচ বিয়ের পরিণতি স্বরূপ, এখন নিজের মেয়েটিকে, একটা ট্রমাটিক রিলেশন থেকে বের হয়ে এসে হীলিংয়ের সুযোগ না দিয়ে আবার ঠেলে দিতে চাচ্ছেন আরেকটি ট্রমাটিক রিলেশনশিপে বিয়ের মাধ্যমে। কারণ ওনার বিলিভ সিস্টেম ওনাকে বিকল্প কিছু ভাবার অপশন দিচ্ছে না। এটাকে আমরা বলি, limitation of thoughts. ওনার ধারনা, উনি যা বুঝছেন, আর কেউ সেটা বোঝেনা। ভিন্নমতকে স্বাগত না জানাতে পারাটাই, limitation of thoughts.
উনি যদি একবার মেয়েটিকে বলতেন, ” দেখো মা যা হবার হয়েছে, তুমি তোমার মতন করে নিজের আগামী জীবনটাকে গুছিয়ে নাও, তুমি তিরিশ বছরের পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ। ভুল করবে, আবার ভুল থেকেই শিখবে; তুমি যাই করো না কেন আমি আমরণ তোমার সাথে আছি। তুমি ভয় পেয়ো না।” তাহলেই কিন্তু মেয়েটির ঘুরে দাঁড়ানো অনেক সহজ হয়ে যেত।
সাধারণত একটা ডিভোর্সের পড়ে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর সময় লাগে নিজেকে গুছিয়ে আনতে। ক্ষেত্রবিশেষে কমবেশি হয়। হীলিং এর জন্য এই সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যারা পূর্ণবয়স্ক সন্তানের জীবনে নিজের ভালো-মন্দ জ্ঞান বিতরণ করতে নাক গলান, তারা কি একবার ভেবে দেখবেন, নিজের কেমন লাগতো যখন তাদের উপর এরকম কিছু চাপিয়ে দেয়া হতো ?
রবীন্দ্রনাথের কর্ণ কুন্তী সংবাদ একটা চমৎকার লাইন আছে, কর্ণ বলছেন কুন্তিকে, ” সন্তান সে নহে মাত সম্পত্তি তোমার।”
কাজেই সন্তানের প্রতি অতি রক্ষণশীল মানসিকতা, সব সময় উপদেশ দেয়া, সব সময় শুধরে দেয়ার অপচেষ্টা, জাজমেন্টাল তীরে বিদ্ধ করা সন্তানের জন্যই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে।
সন্তান একটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ, আর ভালোলাগা মন্দলাগা ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। সে বিকশিত হোক নিজের আলোয়। চলার পথে সে ভুল করুক, ভেঙে পরুক, হেরে যাক আপনি শুধু তার পাশে থাকেন। তাকে সাহস দিয়ে বলেন, ” ভয় পেয়ো না।”
সন্তানের পাশে থাকুন সব সময়।

পর্ব-৩৪

“ বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বশ করা,জগতে এতবড় জয় আর নাই। ” মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
মেয়েটি ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, ইংরেজী মিডিয়ামে। বিদেশে এপ্লাই করছে স্কলারশিপের জন্য। অ্যাপ্লিকেশনের অনুষঙ্গ অনলাইনে পেমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ডে। মায়ের বান্ধবী এগিয়ে আসলেন; বাচ্চাটির সাথে তাঁর অসম্ভব হৃদ্যতা।
মেয়েটির মাকে বারবার বলেছিল, ” কিছু এডভান্স টাকা দিয়ে রাখো আন্টিকে।”
অগ্রীম টাকা গ্রহণে স্বভাবতই সেই আন্টি আঙ্কেল যখন তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন, মেয়েটি তখন সবার সামনেই স্বভাব বিরুদ্ধ কেঁদেকেটে হুলুস্থুল করলো। অথচ মেয়েটি বয়স আন্দাজে অতিরিক্ত ম্যাচিউর।
মেয়েটির এক কথা, ” তোমরা টাকা না নিলে আরো কিছু অ্যাপ্লিকেশন আছে সেগুলো আর তোমাদেরকে দিয়ে অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ফি দেওয়াতে পারবো না।”
এমনকি মেয়েটির মা একপর্যায়ে খেয়াল করলো, বাচ্চাটির শ্বাসকষ্টের মতন টান উঠেছিল। সেই আঙ্কেল আন্টি ও মহা অপ্রস্তুত। মেয়েটিও অপ্রস্তুত। এক কথায় যারা যারা ছিল সবাই হতভম্ব।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
প্রায় ১০ বছর আগে মেয়েটির বাবা-মা আলাদা হবার পর থেকে তিন ভাইবোনই মায়ের সাথে অন্য শহরে থাকে।
মেয়েদের বাবার প্রতি সাধারণত প্রচণ্ড আকর্ষণ থাকে। এখানেও তাই। আর কে না জানে ‘প্রত্যেকটা বাচ্চার জীবনের প্রথম হিরো তার বাবা।’ পুরুষ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাও বাবাকে দিয়েই হয়।
আলোচ্য বাবাটি প্রচন্ড বিদ্বান ও সম্পদশালী। অথচ প্রথম তিন বছর সে একটা ফোনও করেনি বাচ্চাদের। পরবর্তীতে এক পর্যায়ে মেয়েটির মায়ের প্রচেষ্টায় যোগাযোগ স্থাপিত হলে বাচচাদের বাবার বাড়ি যাওয়া আসা শুরু হয়। তখন বাচ্চারা খেয়াল করে, বাবা অন্যদের সামনে, বাচ্চাদের মিস করছে বলে যত গল্পগাঁথা শোনান, তার সিকিভাগ চেষ্টাও বাচ্চাদের সাথে যোগাযোগে ব্যয় করেন না। আবার বাবার ধারণা তার কষ্ট বাচ্চারা বুঝে না। বাচ্চাদের কথা হল যদি এতই ভালবাসে, বাবার কাছে যেতে চাইলে, সব সময় কেন বাবা তাদেরকে অ্যালাউ করে না?
এধরনের ব্রোকেন ফ্যামিলি বাচ্চারা এমনিতেই নিজ অবস্থানের ব্যাপারে যথেষ্ঠ সেনসিটিভ। এক্ষেত্রে তিন ভাইবোন হাওয়ায়, নিজেরাই বাবা মায়ের আচরণের পোস্টমর্টেম করে।
স্বাভাবিকভাবেই একজন মা যখন তিন বাচ্চার দায়িত্ব নেন, তখন তিনি মায়ের দায়িত্ব থেকে এক ধাপ বেশি করলেও বাবা-মা উভয়ের রোল পরিপূর্ণভাবে প্লে করতে পারেন না। কাজেই বাচ্চাদের জীবনে অপ্রাপ্তির বঞ্চনা অবশ্যই থাকে। যদি এক কথায় বলি, তবে এই ক্ষেত্রে বাচ্চাদের core issue : missing acceptance.
পরবর্তীতে মেয়েটির নজরে পড়ে বাবা ভাইদের প্রতি বেশি সদয়। ফলে এই মিসিং একসেপটেন্স এর অদৃশ্য ছায়া, মেয়েটির ফ্রকের ঝুলের সাথে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে বালিকা থেকে কৈশোরে।
মা’ ও মাঝে মাঝেই, নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করত রাগ দিয়ে। বলতো,” বাপের কাছে থেকে আসো, কিছুদিন। I need a break. “
বাচ্চাগুলো মায়ের কষ্ট দেখে বাবার অবহেলা বুঝলেও নিজেরাই গোপনে আলাপ করতো। চোখের সামনে মায়ের সংগ্রামটা দেখে মায়ের প্রতি খুব বেশি কিছু বলার থাকতো না তাদের। অযাচিত ভাবে গসিপ শোনার উদোগ্র আগ্রহী উটকো আত্মীয়তার মুখোশগুলিকেও চিনে যাচ্ছিল ক্রমাগত।
তারা প্রথমদিকে অপেক্ষা করতো হয়তো কখনো বাবা এসে বলবে, “চলো আর নানা বাড়ী থাকতে হবে না, তোমাদের নিজ বাড়ি নিয়ে যাই।”
এমনকি সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম চলে আসার পরে ডিসেম্বরে বাবার জন্মদিনে, ক্লাস ফোরে পড়ুয়া মেয়েটি, মায়ের সাথে যেয়ে একটা উপহার কিনে পাঠায় কুরিয়ারে। ভাবে বাবা এটি পেয়ে খুশি হয়ে তাকে নিতে আসবে। বাবা সেটা পেয়েছে সেই তথ্যটিও জানাবার প্রয়োজন বোধ করে না।
ভদ্রলোক তিন বছর সামান্যতম যোগাযোগ করে না, হয়তো ভেবেছিল ভদ্রমহিলা একা সামলাতে না পেরে ভোঁতা মুখ থোতা করে আবার ফিরে যাবে পুরানো জীবনে। এদিকে বাবা জানতেও পারল না, অধীর আগ্রহে তার ছোট্ট মেয়েটা ফ্যান্টাসিতে ভোগে, বাবা অবশ্যই একদিন এসে তাকে নিয়ে যাবে।
বছর চারেক পরে মেয়েটির মা একটা ট্রেনিংয়ে যাবে সিঙ্গাপুরে, সাথে বাচ্চারাও যাবে। সেই জীবনের প্রথম বাচ্চাগুলোর বিদেশ ভ্রমণ।
মেয়েটি খুব আগ্রহের সাথে বাবাকে বললো, ” বাবা আমরা সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাব, আমি শপিং করব, তুমি আমাকে টাকা দাও।”
তখন বাবাটি বললো, ” আমি টাকা দিতে পারব না তুমি একটা নতুন বাবা খুঁজে নাও।” আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রোপিত হলো আজকের কাউন্সেলিং টেবিলের গল্পের বীজ।
আমাদের শরীর যখন আর ব্যথা সহ্য করতে পারে না, তখন অজ্ঞান হয়ে যায়। আমাদের সচেতন মন কষ্ট নিতে নিতে যখন আর সেই ব্যথা সহ্য করতে পারে না,তখন অবচেতনভাবে নিজের চারপাশে চীনের দেয়ালের মতো রক্ষা প্রাচীর তুলে ফেলে।রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যেমন কিছু উপজাত দ্রব্য তৈরি হয়। অবচেতন মন সেরকম সচেতন মনকে না জানিয়েই ভবিষ্যতে এই ধরনের কষ্ট থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অবচেতনভাবেই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো সাইকেল অফ ডেভলপমেন্ট এ বলে ১৯ বছরের আগেই মানুষ নিয়ে ফেলে।
এই মেয়েটির সিদ্ধান্ত ছিল, “আমার কোন কাজের জন্য অন্যের কাছে পয়সা নেবো না।”
সেই ধারাবাহিকতায় আজ যখন, তার আন্টি আঙ্কেল এডভান্স অ্যাপ্লিকেশন ফী এর টাকাটা নিলেন না, মেয়েটির সাথে সাথে এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করল, যেটা তার অভ্যস্ত আচরণ এর বাইরে।
যেকোনো পরিস্থিতিতে মেয়েটা যখন থ্রেট ফিল করে তার সেই গভীর গোপন কষ্টের জায়গায় ট্রিগার হয়, তখনই সে এই অযাচিত রক্ষণাত্মক আচরণগুলো নিজের অজান্তেই করে; আগামীতেও করবে। এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি ভালো কাজ দেয় হিলিং এ। তবে একমাত্র যদি মেয়েটি সাইকোথেরাপি নিতে তৈরি হয়, ওপেন আপ হয় তবেই। মেয়েটির মা জোর করে ধরে বেঁধে আসলে মেয়েটি রাজি না থাকলে সাইকোথেরাপিতে কাজ হবে না।
বিয়ে একটি দলিলবদ্ধ সম্পর্ক। একটি চুক্তি। প্রয়োজনে চুক্তি বাতিল হতে পারে। কিন্তু বাবা-মার সাথে সন্তানের সম্পর্কটা কোনো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নয়। জীবনসঙ্গীর সাথে ছাড়াছাড়ি হতেই পারে। তার জন্য সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় বিধান রয়েছে। জীবনসঙ্গীকে কাট করে দিতে যেয়ে যারা সন্তানদেরকেও মাইনাস করে, তাদের মত ক্ষুদ্রবুদ্ধি, হতভাগ্য আর কে আছে?
বাবা-মার বিচ্ছেদের ইঁদুর-বিড়াল খেলায় সন্তানদের ইমিডিয়েট ক্ষতিটা বোঝা না গেলেও বাবা-মা যদি বাচ্চাদের মনের যত্ন না নেন বহু বছর পরে বাচ্চারা এ্যাডাল্ট হলেও এই বিচ্ছেদের কুপ্রভাব অবশ্যই পড়বে। কাজেই একটা Abusive সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাটা যেমন জরুরি, তেমনই ডিভোর্স পরবর্তী বাচ্চাদের মানসিক যত্নের জায়গাটা প্রায়োরিটি দেওয়াও জরুরী।
যেসব বাবা মা বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী সময় বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

পর্ব-৩৫

” ম্যাডাম, আমি আপনার ছাত্রী ছিলাম একযুগ আগে। বিয়ে হয়েছে ৮ বছর। ২ বাচ্চা; বড়টা ৭ বছর, ছোটটা ২০ মাস। ঢাকার বাইরের শ্বশুরবাড়ী। পোস্ট গ্রাজুয়েশনে চান্স পেলেও শ্বশুরবাড়ির কেউ ঢাকা যেতে দিতে রাজি না থাকায় কোর্সে ঢুকি নাই। গতবছর আমার শহরেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ঢুকি আর এরই মধ্যে ৩৯ বিসিএস হয়। সরকারি চাকরি করি এতে হাসব্যান্ড,শ্বাশুড়ি কেউ রাজি ছিল না। আমার বাবা, মা ও আমি অনেক অনুরোধ, কান্নাকাটির পর বিসিএস এর কর্মস্থলে আসার অনুমতি পাই।
আমার শ্বাশুড়ি ভীষণ রকমের ঝামেলার মানুষ, ওনার মেন্টাল টর্চার সইতে না পেরে অনেক বার সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উনি ওভার পসেসিভ।
নতুন কর্মস্থলে, বাচ্চাদের নিয়েই একা জয়েন করি। জায়গাটা আমার বাবার বাড়ী বা শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক দূর। এখানে বাচ্চাদুটো নিয়ে আমি একাই থাকি, কাজ করি।
এরমধ্যে আমার শ্বশুর কোভিড সিম্পটম নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি হন। শোনা মাত্র আমার বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ী যাই। যেহেতু ডাক্তার বউ সব দায় দায়িত্ব যেন আমার একার। ১০ দিন পর শ্বশুর মারা গেলেন। আমার ছুটি শেষ হলেও শাশুড়ী একা ফিল করবেন বলে, আমার স্বামীর অনুরোধে আমার বসকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনের কথা বলে ছুটি বাড়াই। কারণ করোনার সময় সমস্ত সরকারি চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকাটা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। এর মধ্যেই দাদা শ্বশুর মারা যান। উনাকে নিয়ে ৩-৪ দিন আইসিইউতে ছুটাছুটি করেছি। আমার শাশুড়ী ছুটি শেষ হলেও আমাকে আসতে দিতে রাজি না কারণ আমার শ্বশুর বাড়ির অনেক আত্মীয় স্বজন অসুস্থ। ডাক্তার বউ ছাড়া তাদের কে দেখবে?
আমার বস আর কোনভাবেই ছুটি বাড়াতে রাজি না হওয়ায় আমি কর্মস্থলে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আসার আগের দিন আমার হাসব্যান্ডের কোভিড পজিটিভ আসে। ওর সব ইনভেস্টিগেশন করাই, ওর সব রিপোর্টস নরমাল আসে; তেমন কোন সিম্পটম না থাকায় আমি ওর কাছে আমার ছুটির সমস্যার কথা বলে অনুমতি চাইলে সে অনুমতি দেয়।
মাঝে ঝামেলা পাকালো আমার শাশুড়ী। ছেলের কাছে কান্নাকাটি করে বুঝালো ছেলের পজিটিভ, আমাকে কিভাবে এই অবস্থায় আসার অনুমতি দেয়? এরপর ছেলে ও গেল বিগড়ে। ওর মা কেন কান্নাকাটি করল সেই জন্যে আমাকে আসতে দিবেই না। অনেক অনুরোধে ঢেঁকি গিলে কর্মস্থলে যোগ দিলাম। কিন্তু আসার পর থেকে আমার হাসব্যান্ড আমাকে কোন ফোন কল দেয় না, আমি ফোন দিলেও ধরে না। আমি text করতেই থাকি,কোন response নাই। বাচ্চারা বাবার সাথে কথা বলার জন্য কান্না করে, আমি অনবরত কেঁদে যাচ্ছি। কিছুতেই পাথর গলেনা। এদিকে আমার বার বার panic attack হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমার শাশুড়ীকে ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে বল্লাম,আম্মা আমি চাকরি ছেড়ে দিব,আপনারা যেভাবে বলবেন সেই ভাবেই চলবো….।”
এই মেয়েটি চিকিৎসক এবং একজন সরকারি কর্মকর্তা। নির্যাতন দুই রকম হয়। একটি শারীরিক, একটি মানসিক। শরীরে মারের দাগ দেখা যায়, কিন্তু মনের আঘাতে চিহ্ন দেখা যায় না।
মানসিক নির্যাতনের মাত্রা কতটুকু তীব্র হলে, এরকম সুস্থ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন একটি মেয়েকে আত্মহত্যায় প্রচারিত করে, এই দুর্মূল্যের বাজারে সরকারি চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে, কিংবা সোনার হরিণ সম পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স এ চান্স পেয়েও সেটা ভর্তি হতে দেয় না?
এরপর সে কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
কাউন্সেলিং কি আসলে মেয়েটির লাগবে? নাকি শাশুড়ি ও স্বামী লাগবে?
স্বামীত্বের অধিকারে ফলানো বা পিতৃত্বের অধিকার ফলানো যতটা সহজ নিজের সম্মানটা স্ত্রীর কাছে প্রতিষ্ঠা করা ঠিক ততটাই কঠিন। একটা পুরুষ একজন নারীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের পরিবারে যখন নিয়ে আসে, তখন স্ত্রীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু পুরুষটির উপরই বর্তায়।
“সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে,” এটা সবাই বলে, কিন্তু পরের অংশটি “গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে” এটা কয়জন বলে?
প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটি আলাদা দাবি আছে। যেমন,
* সন্তানের উপর পিতৃত্বের, ঠিক তেমনি পিতার উপর সন্তানের;
* সন্তানের উপর মাতৃত্বের, তেমনি মায়ের উপর সন্তানের;
* স্ত্রীর উপর স্বামীর তেমনি স্বামীর উপর স্ত্রীর।
পুত্রবধূ কি আসলে শাশুড়ির প্রতিযোগী?
নাকী
উচ্চশিক্ষিত পুত্রবধূ শুধু সামাজিক মর্যাদার শোকেসের পুতুল?
তার অনুভূতি থাকতে নেই?
অন্য পরিবারের একটি মেয়ে,
তার বেড়ে ওঠা আলাদা পরিবেশে। তার চিন্তা জায়গাটা তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আলাদা ঘরানায়;
তার অনুভূতিগুলি, তার DNA code এর মত সম্পূর্ণভাবে আলাদা ( যেমন আপনার পোলাও পছন্দ হলেও আমার ফেভারিট খিচুড়ি)। ফলে তার আচরণ কিন্তু তার অনুভূতি এবং চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। এই অবস্থায় আপনি কিভাবে আশা করেন বউ হয়ে এসেই সে,
* আপনার মনের ভেতর ঢুকে সব বুঝে নিবে?
* আপনি কত টুকু ভালো মানুষ সেটি তাকে বোঝার সময় দিয়েছেন?
* আপনার বাড়িতে যাতে করে সে শারীরিক মানসিক এবং সামাজিকভাবে নিরাপদ বোধ করেন সেই পরিবেশ দিয়েছেন?
* তার ভালো লাগা মন্দ লাগাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছেন?
একটা টব থেকে অন্য টবে গাছ লাগলে সেই গাছটিও কিছুদিন ম্রিয়মান হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে শেকড় উপরে অন্য জায়গায় লাগালে গাছেরও স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। আর এটাতো জলজ্যান্ত একটা মানুষ।
স্বামী বা শাশুড়ি হয়ে আপনারা চাচ্ছেন মেয়েটির কাছ থেকে যা যা চাচ্ছেন, সেটি তাকে দিচ্ছেন তো?
* সম্মান চাইলে আগে সম্মান দিন।
* ভালোবাসা চাইলে আগে ভালোবাসা দিন।
* আনন্দ চাইলে আগে আনন্দ দিন। আপনি মডেলিং করুন, তার সামনে সেই আচরণগুলো করুন যেই আচরণগুলো আপনি তার কাছ থেকে পেতে চান।
খোলা মনে তাকে বলুন, ” তুমি কেমন ফিল করছো?”
তাকে সেই বলার স্পেসটা করে দিন, সেই সাহসটি দিন যাতে সে বলতে পারে, ” আমি আনন্দিত হচ্ছি/ ভয় পাচ্ছি/ দুঃখ পাচ্ছি/ রাগ হচ্ছি তোমার/আপনার এই আচরণে।”
যারা মানসিক নির্যাতনের অদৃশ্য যাতনায় তিলে তিলে জীবনসঙ্গীকে হত্যা করে না তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

পর্ব-৩৬

স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া। বিরোধ তুঙ্গে, ডিভোর্স হব হব। শেষ চেষ্টা হিসেবে হালের নতুন কেতা ম্যারেজ কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হতে হবে পরিবারিক ভাবে ঠিক করা হলো। তবে স্বামী এলেন না। শুধু স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন কাউন্সেলিং এর জন্য।
আমাকে ফোনে বললেন, ” ম্যাডাম যা টাকা লাগে দেবো, আমার বউয়ের মাথাটা ঠিক করে দিন। ওকে আলাদা গাড়ি-বাড়ি, হীরা, গয়না, বিদেশ ট্যুর কিছুই দিতে বাদ রাখিনি। আমার কোন বদ অভ্যাস নাই। অভাব নাই, তারপরও যখন কথা শুনে না তখন কিভাবে মেজাজ ঠান্ডা রাখি? এমনি কিন্তু ও মেয়ে খুব ভালো। আমার বাবা মা ওকে নিয়ে খুব খুশি। “
স্ত্রীর অভিযোগ,” স্বামী কথায় কথায় রাগ করে, প্রচন্ড ক্ষেপে যায়; গায়েও হাত তোলে।”
বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি উভয় পরিবারই সহানুভূতিশীল। সাধারণত এমনটা হয় না। দুপক্ষকেই মেয়েটা জানিয়েছে। সবারই এক কথা। পুরুষ মানুষের অমন এক আধটু রাগ থাকে। সংসার করতে গেলে মেয়েদেরকে কত কিছু সহ্য করতে হয়। মানিয়ে নাও। এই মানাতে না পারাটা মেয়েটার মানসিক অক্ষমতা বিধায় কাউন্সেলিং এর জন্য মেয়েটাকেই একা আসতে হয়েছে।
মেয়েটি বলছেন,” ম্যাডাম সারাক্ষণ একটা ভয়, কখন রাগ করে? কিসের জন্য রাগ করে? কিভাবে রাগ করবে? কার সামনে রাগ করবে? কখন মারবে ? কিভাবে মারবে? কার সামনে মারবে? কেন মারবে? আমি সেই ভয়ে ২৪ ঘণ্টা তটস্থ হয়ে থাকি। আর পারছি না। আমাকে ভালোবাসে না সেটাও বলবো না। একটা চাইলে দুটো দেয়। কিন্তু ইদানিং আমি ওকে দেখলে এত ভয় পাই, আমার মনে হয় ও না থাকলেই আমি ভালো থাকি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আমাদের সমাজে একটা ছেলে শিশু যখন ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠে, তখন আমরা বাচ্চাটি পড়ে গেলে বলি, ” ছি, ছি, তুমি কাঁদছো কেন? ছেলেদের বুঝি কাঁদতে হয়?”
আবার বাচ্চাটি ভয় পেলে বলি, ” ভয় পাচ্ছো কেন তুমি না ছেলে? ছেলেদের ভয় পেতে হয় না।”
আমাদের বেসিক ইমোশন মাত্র চারটা।
* আনন্দ,
* দুঃখ,
* ভয়,
* রাগ।
এভাবে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠার ধাপগুলিতে প্রতিটি ঘটনায় সেই ছোট্ট ছেলেটিকে আমরা ভয় পেতে, দুঃখ পেতে বার বার বারণ করি। ছেলেটি ভুলেও যায় কত লক্ষ বার এই কথাগুলো সে শুনেছে। এসব নিষেধ শুনতে শুনতে একসময় ছেলেটি যখন বড় হয়ে ওঠে সে তখন মনে করে ভয় বা দুঃখ প্রকাশ করাটা তার পৌরুষের পরিপন্থী বা অসহায়ত্বের চিহ্ন।
তাই চারটা বেসিক অনুভূতির মধ্যে তার হাতে থাকে শুধু আনন্দ আর রাগ। ছেলেটি ভয় পেলেও রাগ দেখায়, ছেলেটি দুঃখ পেলেও রাগ দেখায়। কারণ ছোট থেকে ছেলেটি সেটাই শিখে এসেছে। সে জানে ভয় আর রাগ প্রকাশ মানে দুর্বলতা।
এদিক থেকে মেয়েরা কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করতে পারমিশন পায়। এই সমাজ মেয়েদের রাগ প্রকাশ এর ক্ষমতা দেয় নাই। মেয়ে মানুষের এত রাগ কিসের? এই বস্তা পচা ধারণা এখনো ঘুনে ধরা সমাজের কোন কোন ( আশার কথা হলো সবাই না) পচা মাথায় কিলবিল করে। তাইতো প্রবাদ বলে, ‘ছেলেরা রাগলে বাদশা আর মেয়েরা রাগলে বেশ্যা।’
এই ঘুনে ধরা সমাজ ছেলেদের হাতে কি তুলে দিয়েছে? আমরা অ্যাংরি ইয়ং ম্যান পছন্দ করি। কিন্তু কখনো কি ভাবি যে ছেলেটিও একটি মানুষ। ওর পূর্ণ অধিকার আছে ভয় পাওয়ার, দুঃখবোধ করার।
একটা মানুষ ভয় পাবে দুঃখবোধ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক যেরকম মেয়েদের রাগ করবার অধিকার আছে। ফলে ছেলেটিও কিন্তু কোনও অব্যক্ত ভয় বা বেদনায় কষ্ট পাচ্ছে। দীর্ঘদিন অনভ্যাসের কারণে, সে এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে ভুলে গেছে। তাকে সমাজ শিখিয়েছে, আনন্দর বাইরে শুধু আছে রাগ। তাই ছেলেটি,
* রাগ অনুভব করলেও রাগ দেখায়,
* ভয় অনুভব করলেও রাগ দেখায়,
* কষ্ট অনুভব করলেও রাগ দেখায়।
আরেকটি ধারণা হচ্ছে স্ত্রীতো আমার সম্পত্তি। আসলেই কি তাই? একটা মানুষ কি আরেকটা মানুষের প্রপার্টি হতে পারে?
আপনি যদি একজন পুরুষ হন তবে একবার কি খেয়াল করা যায়,
* এই ভাবনাটি কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছে?
* এই ভাবনাগুলো কি আজকের ভাবনা?
* এই ভাবনাগুলো কতদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে?
* এই কথাগুলো কারা বলতো?
* এই ভাবনাগুলো আজকের যুগের জন্য কতটুকু লজিক্যাল?
* এখন একজন পরিপূর্ণ অ্যাডাল্ট পুরুষ হিসেবে:
@ আমার অনেক রিসোর্স হয়েছে,
@ আমি বড় হয়েছি,
@ নতুন আইডেন্টিটি হয়েছে
* এই অবস্থায় এই ভাবনা গুলো নিয়ে আমি কি খুশি থাকতে পারছি?
* এই ভাবনাগুলো যদি আমাকে অখুশি করে তবে এই ভাবনা তৈরিতে আমার ভূমিকাটা কোথায়?
* যদি নিজের ভূমিকাটা খুঁজে না পাই তবে পেশাজীবী সাইকোথেরাপিস্ট বা কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে কোন চিন্তাটা আমাকে বাধা দিচ্ছে?
* সবকিছু স্ত্রীকে দেবার পরও কেন নিজে খুশি থাকতে পারছি না?
এই ভাবনাগুলো একা একা আপন মনে একটু ভাবলে ক্ষতি কি? নিজের জন্য এটুকু চেষ্টা তো করাই যায়? তাই না?
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই মানুষগুলি যারা নিজের চারটা বেসিক অনুভূতি ( রাগ, ভয়, আনন্দ, দুঃখ) প্রয়োজনে প্রকাশ করেন এবং অন্য কেও তার অনুভুতি প্রকাশ করবার সম্মানজনক স্বাধীনতা দেন ( মেনে নেওয়া না নেওয়া নিজের ব্যাপার, তাই বলে প্রকাশ করতে দোষ কি? ) তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পুনশ্চ: কাউন্সেলিং টেবিলের গল্পগুলি সবই আমার অভিজ্ঞতা লব্ধ। সেই পুরুষটি কিন্তু পরবর্তীতে একাধিকবার কাউন্সেলিং এ এসেছেন। তাদের চমৎকার একটা মেয়ে হয়েছে আজ। ভদ্রলোক আমাকে ফোনে বললেন, ” ম্যাডাম, আমার মেয়ে হয়েছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রথম ভিডিও কলটা আপনাকে দিলাম। আমার ঘুরে দাড়ানোর গল্পটা সবাইকে বলেন। আজ সবার কাছে দোয়া চান আমাদের জন্য।”

পর্ব-৩৭

” আমার স্ত্রীর কোন ব্যাপারে কখনো না করিনি, কিন্তু কোনদিনই সে আমার কষ্টটা বোঝে নাই । এমনকি বাচ্চাগুলোকে পর্যন্ত নিজের দলে ভিড়িয়েছে। আমি কেন এই সম্পর্কে থাকবো? বহুৎ সহ্য করেছি, আর না। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। আপনার সাথে আসলে কথা বলারও আমার কোন ইচ্ছা নেই। নিতান্তই বাধ্য করেছে পারিবারিকভাবে তাই এসেছি, কোন উপদেশ শুনতে আসিনি। আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে লাভ হবে না। ১০ মিনিট পরে উঠে যাবো, আশা করি কিছু মনে করবেন না।”
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,
” আমি শুধু আপনাকে দুটো কথা বলবো;
প্রথমত,কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া না। এটা একটা ভুল ধারণা যে কাউন্সিলর বলে দেয় কি করবেন।
দ্বিতীয়ত, আপনাকে কনভিন্স বা ম্যানিপুলেট করা আমার পেশাগত নীতিবিরুদ্ধ। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আপনি কথা বলতে রাজি না থাকলে, সেশন কন্টিনিউ করার প্রয়োজন দেখিনা। “
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন,”তারমানে আপনি আমাকে উপদেশ দেবেন না?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “উপদেশ কি আপনি নিজে কম জানেন, যে ঠেকায় পড়ে আমার কাছ থেকে টাইম, এনার্জি, মানি নষ্ট করে সেটা পয়সা গুনে শুনতে হবে?”
ভদ্রলোক অবাক হয়ে, ” তাহলে আপনি কি করেন?”
আমি, ” It’s a very good question. যদি কোনো কারণে কারো খুব দুঃখ হয় বা কেউ রাগ করে বা মানুষটি ভয় পায় তবে সে আমার কাছে আসে, পেশাগত দক্ষতায় সিড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের মত আমি ধাপে ধাপে তার সচেতন আর অবচেতন মনকে ডিসেকট করে দেখি মনের কোন ঘরে কি কি অনুভূতি আর চিন্তা ঘাপটি মেরে আছে। যা সেই মানুষটির আচরণকে প্রভাবিত করে। তারপর কি করতে হবে, কি না করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত সেই মানুষটিই নেয়। আমার সেখানে কোনো রোল নেই।”
ভদ্রলোক একটু ঠোঁট বাঁকা করে,” আপনি মনের ঘরে ঢুকতে পারেন?”
আমি স্থির চোখে,” হ্যাঁ।”
ভদ্রলোক, তাচ্ছিল্যের গলায়, “আমার মনের ঘরে চাইলেই ঢুকতে পারবেন?”
আমি, ” সেটা নির্ভর করছে যদি আপনি আমার পেশাগত দক্ষতাকে সম্মান জানিয়ে সত্যি নিজের মনের ঘরটাকে খুঁজে দেখতে রাজি থাকেন। তাচ্ছিল্য থাকলে অবশ্যই না, আর মানুষ হিসেবে আমার দক্ষতারও একটা সীমাবদ্ধতা থাকে, সেরকম হলে কি সমস্যা সেটা বুঝে আমি প্রয়োজনে রেফার করে দেই। আর আপনার যেমন, আমাকে চুজ করবার রাইট আছে, আপনাকে নিয়ে কাজ করবো কিনা আমারও সেটা ভাবার রাইট আছে। ভালো কথা দশ মিনিট কিন্তু হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আবার একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
চোখাচোখির এই খেলাটা আমি ভালোই পারি। কারণ ছোটবেলায় একজন একজনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি সে খেলাটা খেলতাম। বড়বেলায় শিখেছি, মানুষের মস্তিষ্কের সাথে ডাইরেক্ট কমিউনিকেট করার ক্ষমতা শুধুমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে সম্ভব। কারণ মস্তিষ্ক সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের অংশ। সেখান থেকে কানেক্টেড থাকে চোখের রেটিনায় অপটিক নার্ভ। তাই একটা গান যে আমরা শুনি, ‘ কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় সে যে মুখে বলা যায় না, চোখের কথা মনের কথা, চোখ যে মনের আয়না।’ কথাটা এনাটোমিকালী সত্য।
ভদ্রলোক খুব শান্ত গলায় বললেন, “আমার স্ত্রী আমার কাছ থেকে পারমিশন নেবার প্রয়োজন বোধ করে না। ও পারমিশন চাইলে আমি না করব না, কিন্তু ওকে তো চাইতে হবে। এটা নিয়ে আপনার কিছু করার আছে?”
আমি, ” কাউন্সেলিং এর মূলমন্ত্র হলো, you can’t change others, you only can change yourself. আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাজ করার কিছু নেই, আমার সামনে এখানে তিনি নেই, আমার সামনে আছেন আপনি। আপনি যদি চান আমরা এটা নিয়ে কাজ করতে পারি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোক একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান। পরিবারের বড় ছেলে। বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। কথা প্রসঙ্গে বের হয়ে আসলো, তার বাবা-মার বয়সের পার্থক্য ছিল ১৬ বছর। মা ছিলেন বাবার ছাত্রী। মায়ের ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়; আর বছর ঘুরতেই ভদ্রলোক জন্মান। বয়সের পার্থক্যের জন্য, বাবা-মার মধ্যে স্বাভাবিক খুনসুটি সম্পন্ন দাম্পত্য আচরণের বদলে আজীবন তিনি দেখে এসেছেন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক।
ভদ্রলোকের বাবা, ভদ্রলোকের মাকে আর ভদ্রলোককে একই টেবিলে পড়াতে বসাতেন। পরবর্তীতে মায়ের পিএইচডি করা পর্যন্ত ভদ্রলোক দেখেছেন বাবাকে একইভাবে গাইড করতে। ফলে, ভদ্রলোক দেখেছেন আশৈশব মা বাবার কাছ থেকে পারমিশন চেয়েছেন, ঠিক যেমনটি ভদ্রলোকও চেয়েছেন। সব সময় স্বামীর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে এই মেসেজটাই ভদ্রলোক পেয়েছেন অবচেতন ভাবে।
ভদ্রলোক বাবার শাসনের বাইরে মুক্তির স্বাদ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। প্রথম বছরেই ক্লাসের বাবুই পাখির মতন ছোটফটে মেয়েটির প্রেমে পড়েন। ভদ্রলোক যেহেতু জীবনে নিজের ইচ্ছাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারমিশন পাননি বাবার কড়া শাসনে, তাই মেয়েটি যখন অবলীলায় নিজের ইচ্ছাগুলো বলতো অবাক হয়ে যেতেন। তবে প্রেমে পড়েছেন এটা বলতেও সময় লেগেছিল ৭ বছর। তখন দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত বিদেশে। এরপর যা হয় বিয়ে, সংসার জীবনের চাকা ঘুরে চলে।
কিন্তু ধীরে ধীরে তিক্ততা জমতে থাকে। কারণ ভদ্রলোকের ‘বিলিভ সিস্টেম’ বিশ্বাস করে স্ত্রীকে সবকিছুতে পারমিশন চেয়ে নিতে হয়। অধ্যাপনা পেশা ভদ্রলোকের পারমিশন দেবার ধারণাকে রিইনফোর্স করতে থাকে। ভদ্রলোক অবচেতন ভাবেই তার বাবার ভূমিকায় ঢুকে যান যা ছোটবেলায় দেখে এসেছেন। ক্রমান্বয়ে তিক্ততা তৈরি করে রাগ। এই রাগ এখন এমন পর্যায়ে যে ভদ্রলোক ডিভোর্সের জন্য তৈরি।
আমি ভদ্রলোককে বললাম, “আপনার ১৬ বছরের ছোট কেউ আর সমবয়সীর সাথে আচরণ কি একি হবে?”
আবার সেই ঠায় তাকিয়ে থাকা।
পুনশ্চ : অনেকদিন আগে ডাক্তারদের ক্ষেতের কলাটা মুলাটা ভেট দেওয়া প্রচলন ছিল। দিন পাল্টেছে। ইদানিং সেই ভেট রূপান্তরিত হয়েছে ট্রিট নামে ফুডপান্ডার সাহায্যে করোনাকালে। সেই ধারাবাহিকতায় ভদ্রলোক চাইনিজ খাবার পাঠিয়েছেন। কারণ সেকেনড ওয়েভ শুরু হয়েছে। আর কে না জানে কেউ কেউ আজও ট্রিট পেতে ভালোবাসে।

পর্ব-৩৮

” আমাকে কেউই পছন্দ করেনা, কিছু বলতে গেলে এখন ভয় লাগে।” ভদ্রমহিলা বললেন।
ভদ্রমহিলা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পোস্ট ডক্টরেট, আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং নারীবাদী খেতাব সবই তার ঝুলিতে আছে। তীব্র কট্টর ভাষী, ডাকসাইটে সুন্দরী এবং পুরুষ বিদ্বেষী বলে তিনি নিজ পরিমণ্ডলে স্বমহিমায় খ্যাত।
যে মানুষটি অঙ্গুলি হেলনে আন্তর্জাতিক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে অভ্যস্ত, এহেন কথন আসলেই তার মুখে বিস্ময়কর। ব্যক্তিজীবনে ও তার প্রচন্ড দূরত্ব তৈরি হয়েছে জীবনসঙ্গী এবং সন্তানের সাথে।
তিনি বললেন, “সানজিদা আমার জীবনে নাম, যশ, অর্থ, খ্যাতি সবই আছে কিন্তু হারিয়ে গেছে বেঁচে থাকার আনন্দ; আমি নিজেকে কোথাও ফিট করতে পারিনা, এমনকি রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর কাছেও আমার গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর কত? এখন এই মধ্য পঞ্চাশে আর নিতে পারিনা।”
প্রচন্ড সফল একজন মানুষ যখন তার ঈর্ষণীয় সাফল্যকে অগ্রাহ্য করে নিজের এই কষ্টের কথা তুলে ধরেন, তখন এটা বলাই বাহুল্য তিনি কতটুকু নিরুপায় বোধ করেন।
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রমহিলা ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ করে আসছেন নিজের অবস্থান ঠিক করতে। কারণ তিনি ছিলেন মেজো। ফলে তাকে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। কারণ বড় বোনের প্রথম সন্তান হিসেবে একটা অবস্থান ছিল। এরপর ছোট ভাইয়ের পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে একটা স্ট্যাটাস ছিল। আশৈশব ভদ্রমহিলার অবস্থান ছিল ফ্লোটিং। বাবা-মা তাকে কম দেন নাই, কিন্তু তিনি সেটা সেভাবে ফিল করতে পারেননি। বাবা-মা বুঝতেও পারেননি তাদের ছোট্ট মেয়েটি কতটা কষ্ট পেয়েছে সবকিছু দেওয়ার পরেও।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ…. গোলাপকে বললাম সুন্দর, সুন্দর হলো সে।” অর্থাৎ আমি যে ভাবে বুঝবো, আমার পৃথিবীটা সেরকমই হবে। আমি যদি মনে করি গোলাপ সুন্দর ফুল, তাহলে গোলাপ সুন্দর। আমি যদি মনে করি বেলি সুন্দর, গোলাপের সৌন্দর্য বেলির কাছে বিমর্ষ হয়ে যাবে। কাউন্সেলিং এর ভাষায় এটাকেই আমরা বলি, “There is nothing call right and wrong. Life is a matter of choice either you choose to suffer or choose to enjoy.” সেই ছোট্ট মেয়েটির এখানে উপলব্ধি ছিল ” choose to suffer.”
ভদ্রমহিলা শৈশবে উপলব্ধি করেছিলেন সবকিছু হয় তাকে বড় বোনের থেকে কেড়ে অথবা ছোট ভাই এর কাছ থেকে থেকে ঝগড়া করে নিতে হবে। অধিকার আদায়ে ঝগড়া ছাড়া, সেই ছোট্ট বাচ্চাটির মনোজগতে অন্য কোন অপশন জানা ছিল না।
সবাইকে রাগ দেখানোর পেছনে ভেতরে ভেতরে তিনি আসলে চাচ্ছিলেন যে তাকে গ্রহন করা হোক তিনি যেমন আছেন ঠিক সেভাবেই। মা বাবা কখনোই বুঝেননি যে সিবলিং রাইভালের ভয়ংকর বিষবাষ্পে মেজ মেয়েটার নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের সমাজের একটা প্রচলিত ধারণা যে কারো বাচ্চা হলে শুধু সেই বাচ্চাটাকে গিফট দেয়া। অথচ তার বড় ভাই বোনগুলো আছে। ওরাও তো ছোট মানুষ, ওরা গিফট আশা করতেই পারে এটা আমরা ভুলে যাই। কারণ আমরা প্রত্যেকটা মানুষ চাই অন্যের কাছে এক্সেপ্টেড হতে।
এই ভদ্রমহিলার ছোট ভাই হওয়ার পর সবাই যেভাবে ভাইকে গিফট দিয়েছিল সেটা ভদ্রমহিলা সেই শৈশবে কিছুতেই মানতে পারতেন না। সেখান থেকেই শুরু। পরবর্তীতে সম্পত্তি বন্টনে পুত্র সন্তানের অগ্রাধিকার বোঝাই যায় ভদ্রমহিলাকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে। তিনি নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন।
একদম শৈশবে তার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই আমি খারাপ তাই আমাকে মা ভালোবাসে না। তাই ভাই কে বেশি যত্ন নিচ্ছে। তারপর থেকে সে চেষ্টা করত ভাল মেয়ে হতে। তখন মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় তার লাইফ পজিশন ছিল ‘I am not ok, you are ok.’ এক পর্যায়ে বড় হতে হতে ছোট্ট মেয়েটি এই not ok’ness এর কষ্টটা আর অনুভব করতে চাইল না। তখন সে নতুন ভাবে নিজের মনস্তত্ত্বকে অভিযোজিত করল অবচেতনভাবে। এবং তার এই পরিবর্তিত অভিযোজিত life position হল ‘I am ok, you are not ok’. এরপর থেকে অবচেতনভাবে কোনো বিতর্কে ভদ্রমহিলা হেরে যান নাই। মানুষের একটা কথা মাটিতে পড়তে দেন না। যেকোনো তর্কেই তাকে জিততে হয়। মেধা, বুদ্ধিমত্তা এবং সৌন্দর্য থাকায় যত দিন যেতে লাগল তিনি নিজেকে যেকোনো আসরের মধ্যমনি হিসেবে আবিষ্কার করতে লাগলেন। যেখানেই এর ব্যত্যয় হলো সেখানেই তীব্রভাবে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিজের পরিবর্তিত লাইফ পজিশন রিকনফার্ম করতে। কাজেই ঝগড়া তো লাগতোই। সেটা পারিবারিক হোক, অফিশিয়াল ব্যাপার হোক, অথবা ফেসবুকে। এই ঝগড়াগুলোকে আসলে তিনি অবচেতনভাবে দেখতেন তার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হিসেবে। অজান্তেই উল্টাদিকের মানুষটিকে আঘাত করতেন। কারণ তার সেই, ‘I am not ok’, চিন্তার কষ্টগুলো তিনি আর কিছুতেই নিজেকে দেবেন না অবচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নেন নতুন অভিযোজিত লাইফ পজিশনে।
এখানে ক্রমাগত দূরত্ব তৈরি হয়, পারিবারিক, পেশাগত জীবনে। ফলে সামাজিকভাবে তিনি যতই ঝগড়াটে হিসেবে নাম কিনেন না কেন, বাইরে তার রাগী ও জেদি চেহারাটাই যতই প্রতীয়মান হোক না কেন, তার ভেতরের রিয়েল ফিলিং ছিল, দুঃখ। এক্সেপ্টেড হওয়ার তীব্র বাসনায় কাতর সেই ছোট্ট মেয়েটি, যে নিজেকে শেকড় উপড়ানো উদ্বাস্তু ভাবছে বাবা-মা আর দুই ভাই-বোনের ভিড়ে।
ভদ্রমহিলা সারাজীবন এক্সেপ্টেড হওয়ার এই স্বীকৃতি খুঁজেছেন অন্যের কাছ থেকে। এবং যখনই এটা পাননি, তখনই তার নতুন করে অ্যাডাপ্ট করা life position, I am ok, you are not ok reinforced হয়েছে।
যেকোনো সম্পর্কের হেলদি লাইফ পজিশন হলো, I am ok, you are ok। অন্যের সাথে মতামত এর পার্থক্য থাকবে এটা জেনেও নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে তাকে অসম্মান না করা ক্ষেত্রবিশেষে নিজের মতামত কার উপর চাপিয়ে না দেওয়াটাই I am ok you are ok.
এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যদি আমার নিজের মধ্যে হিংসা থাকে অন্যের প্রতি, তবে একটু খেয়াল করে দেখতে হবে, আমি I am ok you’re ok থেকে কতটুকু দূরে?
যারা নিজের স্বকীয়তা রক্ষা করেন এবং অন্যের বৈপরীত্যকে সম্মান করেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

পর্ব-৩৯

“আমি ভালোবেসেছি একজন বিবাহিত মানুষকে, আমি জানি আপনি আমাকে খারাপ ভাবছেন, সে ফিরে গেছে নিজের জীবন সঙ্গীর কাছে, আমি কিছু পারছিনা ভালো থাকতে। বারবার মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি।”
একটা মানুষ কখনোই এই পৃথিবীর বুক থেকে নিজ অস্তিত্বকে মুছে দিতে চায় না। যদি না তার ব্যথাটা অনেক বেশি হয়। বেঁচে থাকার আনন্দের থেকে যন্ত্রণাটা যদি আনুপাতিক হারে অনেক বেশি হয়, নিরুপায় হয়ে একটা মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে।
প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটি নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া থাকে। একটি বাউন্ডারি থাকে। চাওয়া পাওয়া গুলো এই বাউন্ডারির বাইরে গেলে সম্পর্কটা মুগ্ধতা হারায়। কখনো কখনো ভেঙে যায়।
নারী-পুরুষের চিরন্তন আন্তঃসম্পর্কের জায়গায় ভালোবাসার থেকেও বেশি প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মান। মানুষ একটু কম ভালোবাসা নিয়েও কাটিয়ে দিতে পারে কিন্তু একজন আরেকজনের প্রতি সম্মানটা হারিয়ে ফেললে, সেই সম্পর্ক আর জোড়া লাগে না। ফেসবুকে যতই ঘনিষ্ঠ ছবি বা জন্মদিনে দামি উপহার, ইউরোপ ট্রিপ ইত্যাদি ইত্যাদি কিছুই সেই অদৃশ্য দাগ জোড়া লাগানোর সুপার গ্লু হয় না।
মানুষটি জেনেশুনেও একজন বিবাহিত সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন কোনো কিছু না ভেবেই। প্রত্যেকটা সম্পর্কই হচ্ছে একটা দেয়া নেয়া। ঠিক যেমন ব্যাংকের ট্রানজেকশন। দেয়া নেয়া যে সব সময় অর্থনৈতিক লেনদেন তা কিন্তু নয়। এই দেয়া নেয়া হতে পারে অনুভূতির।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
দুজন মানুষের সম্পর্কে যখন ফাঁক থাকে, তখনই বেনোজলের মতো তৃতীয় জনের আবির্ভাব হয়। তৃতীয়জনে এই ফাক যদি পূরণ না হয়, তবে চতুর্থ পঞ্চমও সময়ের পরিক্রমায় এসে যেতে পারে।
কিন্তু এরকম ঝাকে ঝাকে কৈ মাছ আসলেই কি শান্তি মিলবে?
আমরা একটা সম্পর্ক থেকে কেউ চাই? আমরা খুঁজি পাশে থাকার বিশ্বস্ততা। আমরা প্রত্যেকেই জানি ঋতু পরিবর্তনের মতন মানুষের জীবনে বর্ষা, বসন্ত, শীত আসে। আমার জীবনসঙ্গী একটু কম ভালবাসতেই পারে কিন্তু আমার প্রত্যেকটা মুহূর্তে সে কি পাশে ছিলো?
একটা সম্পর্কে যখন তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব ঘটে তখন সম্পর্কটা কিন্তু মরে গেছে। মরে গেছে দেখেই দ্বিতীয় একজন নতুন চারা গাছে গজিয়েছে। এই গাছটিও যদি, উপযুক্ত যত্ন না পায়, এটিও হয়তো একদিন মরে যাবে।
কাজেই প্রথম যে জিনিসটি খেয়াল করা দরকার, সেটি হলো
* সম্পর্ক বলতে আমি কি বুঝি?
* আমি এই সম্পর্কটি থেকে কি চাই?
* এই সম্পর্কটি কেন করছি?
* আমার কোন প্রয়োজনটা সম্পর্ক মেটাচ্ছে? প্রয়োজনটাকে ভাগ করা যেতে পারে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং স্পিরিচুয়ালিটির জায়গা থেকে।
* এই সম্পর্কটি আমার কাছ থেকে কতটুকু নিল তার বিনিময় কতটুকু দিল? এই দেয়া নেয়া মানে কিন্তু অর্থনৈতিক বা ম্যাটেরিয়ালিস্টিক না। এই দেয়া-নেয়া মানে কতটুকু আনন্দ, ভয়, রাগ বা দুঃখ দিল।
* এই সম্পর্কটি জন্য আমি কি নিজে নিজেকে সম্মান করতে পারছি?
* এ সম্পর্কটির পরিণতি আজকে থেকে ৫ বছর ২০ বছর পরে কি?
* এটা কি সত্যিই প্রয়োজন নাকি ক্ষণিকের মোহ?
একটা সম্পর্কের যখন বাউন্ডারি সেট করা থাকে না, তখন কোনো এক পক্ষ হাঁটতে হাঁটতে হয়তো অনেক দূর এগিয়ে যায় সম্পর্কটিকে বুকে নিয়ে। আরেকজন হয়তো যেখানে ছিল সেই মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে থেকে দুইজনের চাওয়া-পাওয়া ভিন্ন হয়ে যায়। কষ্টের মাত্রাও তখন আলাদা আলাদা হয়। আনন্দের জন্য যে সম্পর্ক তৈরি সেই সম্পর্কের আঘাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মন। এই কষ্টের সমাধান না পেয়ে, আত্মহত্যার কথাও ভাবনাতে চলে আসে।
আমার সম্পর্কগুলোকে বাউন্ডারিতে রাখার দায়িত্ব আমার। আমার সম্পর্কগুলোর দায়িত্ব নিতে আমাকে শিখতে হবে। না হলে আমি হবো আরেক জনের হাতের পুতুল। আর কে না জানে পাপেট শো শুধু দেখতেই ভালো লাগে ক্ষণিকের জন্য।
যেই সম্পর্কে অসম্মান জড়িত, সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসা আশু প্রয়োজন। ঠিক যেমন শরীরে গ্যাংগ্রিন হলে, gangrenous part must be amputated.
যারা সম্পর্কগুলোকে মর্যাদা দিতে পারেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

পর্ব-৪০

“আমার মা আমার সব থেকে বড় শত্রু। এমনকি কি আমার ডিভোর্স এর পেছনেও সেই দায়ী। বললে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু এটাই সত্যি যে আমার মা আমাকে হিংসা করে। মানুষের সামনে জরায় ধরে চুমু খায় অথচ যখন আমার লোনলি লাগে তখন ওনাকে পাওয়া যায় না।”
ভদ্রমহিলা পেশাগত জীবনে সফল। একটি মাল্টিন্যাশনালে কাজ করেন। দেশি-বিদেশি পরীক্ষা পাসের সনদ ঝুলিতে। জ্ঞানে বুদ্ধিতে কোন অংশে কম নয়।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
এই ধরনের টক্সিক বা disfunctional মা মেয়ের সংখ্যা, বিশ্বব্যাপী কিন্তু কম না। ইদানিং বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে এ ধরনের রিলেশনশিপ কনফ্লিক্ট নাকি আরেকটি নিরব মনস্তাত্ত্বিক মহামারী।
আমি আমার কাজের জায়গা থেকে বলতে পারি প্রতিদিনই আমাকে শুনতে হয়, একজন মা কতটুকু দুঃখ এবং হতাশা নিয়ে তার কন্যার বিরুদ্ধে বলছেন এবং কিশোরী অথবা পূর্ণবয়স্ক কন্যা মায়ের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এখানে দুই পক্ষেরই মূল কথা হচ্ছে, অপরপক্ষ কেন আমাকে বুঝে না এবং আমার অনুভুতিগুলিকে সম্মান করে না।
কথায় বলে, মেয়ে নাকি মায়ের মত হয়। খুব অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণায় উঠে এসেছে, মা এবং মেয়ের cortico-limbic morphology বা মস্তিষ্কের কিছু জায়গা গঠনগতভাবে অনেকাংশেই একই রকম। যেটা মায়ের সাথে ছেলের বাবার সাথে মেয়ের নয়। শুধু তাই নয় বাবা-মার জেনেটিক ইনফ্লুয়েন্স বাচ্চাদের বুদ্ধিমত্তা আচরণ এবং ব্রেইন এর উপর পড়ে। মা এবং মেয়ের বন্ডিং শুরু হয় বাচ্চা কথা বলতে শেখার আগে থেকেই। সাইকেল অফ ডেভলপমেন্ট বলে এটা গর্ভকালীন সময় থেকেই শুরু।
যে জিনিসটা খুব খেয়াল করা দরকার, প্রত্যেকটা মানুষের একটা আলাদা আত্মসম্মানবোধ আছে, অনুভূতি আছে। শুধু তাই নয় প্রত্যেকটা মানুষ নিজস্ব একটা স্পেস চায়। আমি মা হয়েছি বলে, ২৪ ঘন্টা লেপ্টে থাকবো বা মেয়ে হয়েছি বলে আমার প্রাইভেসি থাকবে না এই জায়গাগুলো থেকেই কনফ্লিক্টের তৈরি। এমনিতেই মা ও মেয়ের বয়সের পার্থক্যের কারণে জেনারেশন গ্যাপ থাকবে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মতামতের অমিল থাকবে। এই মতামতের অমিলটা কে সম্মান এর সাথে গ্রহণ করতে পারাটাই বাস্তব জ্ঞান।
আমরা একটা শব্দ ব্যবহার করি, টক্সিক প্যারেন্টস। টক্সিক প্যারেন্ট হলেন তিনি যার আচরণে সন্তান মনে করে, ততক্ষণ পর্যন্ত মা তাকে ভালোবাসে না যতক্ষণ পর্যন্ত না, বাচ্চা নতি স্বীকার করছে মায়ের কাছে। এখানে মায়ের বিশ্বাস, ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক’। মতামতের ভিন্নতাকে সামান্যতম সম্মান তিনি করেন না। ফলে বাচ্চারা তাকে ভয় পায়।
টক্সিক মায়ের লক্ষণগুলো কি কি?
* সব সময় দোষ খুঁজবে: এককথায় খুঁত ধরবে, কারন সে সব সময় বাচ্চাকে শোধরাতে চাইবে।
* সবকিছু নিজেকে কন্ট্রোল করতে চাইবে।
* বাচ্চাকে ম্যানিপুলেট করবে আত্মগ্লানিতে ভুগতে।
*এমন আচরণ করবে যাতে বাচ্চা অপমানিত বোধ করে
* বাচ্চার ইমোশনের কোন দাম দেবে না
* মুখে না বললেও আচরণে রাগ দেখাবে
* বাচ্চার যে একটা আলাদা পার্সোনাল বাউন্ডারি এবং স্পেস আছে, যেটা তার একান্ত গোপন, সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই, সেই জায়গাটাতেও মাতৃত্বের দাবি নিয়ে হুটহাট ঢুকে পড়াটা নিজের অধিকার মনে করবেন।
এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, মা কিন্তু পুরো ঘটনাটাই ঘটাচ্ছেন অবচেতনভাবে। একমাত্র সচেতনতাই পারে তাকে এহেন আচরণ থেকে বের করে আনতে। মজার ব্যাপার হলো, টক্সিক মা মেয়ের সম্পর্কর পাল্লা ভারী টক্সিক মা ছেলের সম্পর্ক থেকে। একটা শব্দ ব্যবহার করা হয়, “Mother wound”. দীর্ঘমেয়াদী পুরুষতান্ত্রিক কালচার আসলে মায়ের মধ্যে একটা dysfunctional coping mechanism তৈরি করে। যার কারণে, মা তার কন্যাকে চরম ভালবাসলেও অবচেতনভাবে ভালোবাসাটা হারিয়ে, একটা টক্সিক রেলেশনশিপে পুরো ব্যাপারটা মুগ্ধতা হারায়। ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষরাও কিন্তু এই, “mother wound” এ সাফার করে।
” Mother wound ” এর তলে কি কি বিশ্বাস লুকানো আছে ?
* আমি ভালো মা নই এই ধারণা
* পাছে লোকে কিছু বলে এই লজ্জা
* আমার জীবনের ভুলগুলো মেয়ের মধ্যে ঠিক করছি
* যে সহে সে রহে
*সেই কবিতার মত “ঝিনুক নীরবে সহো” মনোভাব
* আমার প্রয়োজনগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়
* ক্রমাগত শুধরাতে হবে নিজেকে কারণ
* ভিতরে ভিতরে আমি অসহায় কারণ
* আমাকে আরো ভালো হতে হবে। কিন্তু এই ভালোর সীমানা কোথায় শেষ, সেটা তিনি জানেন না।
আমার মা যখন টক্সিক তখন আমি কি করবো?
* একসেপ্ট করুন যে মা এরকম আচরণ করেন
* কিন্তু আপনার প্রতি ভালবাসার কোন কমতি নেই তার, তবে এ ধরনের টক্সিক আচরণ আপনাকে কতটুকু কষ্ট দেয়, সেটা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। এটাই তার limitation of thoughts বা চিন্তার জায়গার দুর্বলতা।
* আপনার নিজের পদ্ধতিতে সফলতা আসলে তাকে নম্রভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান যে তার জানার বাইরেও অন্যভাবেও সফল হওয়া যায়।
* প্রয়োজনে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং এর সাহায্য নেয়া।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মা-মেয়ের যদি টক্সিক সম্পর্ক থাকে, তবে মেয়ে তার আঘাত পরবর্তী জীবনেও long-term ইফেক্ট হিসাবে অনুভব করবে অনুভূতি পরিপূর্ণভাবে প্রকাশের অক্ষমতায়, আত্মসম্মানবোধে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেকে নিজের মতো করে গ্রহণ করার অক্ষমতায়। কাজেই আপনি যদি মা হন এবং আপনার কন্যার সাথে ক্রমাগত বিরোধ থাকে, তবে সেটা যত তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলবেন, তাতে আপনার এবং কন্যার উভয়পক্ষেরই মঙ্গল। প্রয়োজনে অবশ্যই পেশাগত সাহায্য নেবেন।
রবীন্দ্রনাথ কর্ণ কুন্তী সংবাদে চমৎকার একটা কথা বলেছেন, ” সন্তান সে নহে মাত সম্পত্তি তোমার।”
যারা সন্তানকে সম্পত্তি না ভেবে সম্পদ ভাবেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।