“ম্যাডাম আমি কোনো এম্বুলেন্স এর শব্দ শুনতে পারি না। এমনকি সামান্যতম জোরে শব্দ হলেও আমার প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগা শুরু হয়”। মেয়েটি বলল।

তিনি পেশায় তরুন চিকিৎসক। ঢাকার নামকরা স্কুলে কলেজের গণ্ডি পার হয়ে প্রথম শ্রেণীর মেডিকেল কলেজে শেষ দিন পর্যন্ত সরকারি বৃত্তিতে পড়েছেন। এমতাবস্থায় ইন্টার্নশিপ শেষ করার কিছুদিন পরই শুরু হলো প্যানডেমিক। একদম শুরুতেই এপ্রিলে বাবা-মা দুজনই আক্রান্ত হলেন। তখনোও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অতটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি। মা’র অবস্থা শুরুতেই এত খারাপ হয়ে গেল যে তাকে ভর্তি করাতে হলো কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে।

মেয়েটি বলল, “ম্যাডাম আমি যখন মুগদা হাসপাতলে একা একা মা’কে নিয়ে যাচ্ছিলাম, খালি দোয়া করছিলাম মা যেন অ্যাম্বুলেন্সে মারা না যান। অন্তত হাসপাতালে অক্সিজেনটুকু যেনো তার নসিবে জুটে। নিজেকে ডাক্তার হিসেবে এত অপদার্থ মনে হচ্ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তখনো এত থিউরিটিক্যালি সাইটোকাইনিন স্টর্ম, হেপারিন লাগবে এসব তথ্য ওপেনলি আসেনি। মুগদাতে ভর্তি করার পর শুরু হল আরেক যুদ্ধ। জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলাম, কেন রোগীর এটেনডেন্টরা আমাদের ইন্টারনীর সময় ডিউটি ডাক্তারদের রুমে বারবার প্রশ্ন করতে আসেন। নিজেকে এতটা অসহায় কখনো মনে হয়নি। একমাত্র ছোট ভাইটা স্কুলে পড়ে বলে, ও বাসায় বাবার সাথে থাকতো। বাবাও তখন বেড বাউন্ড। এদিকে আমি সম্পূর্ণ একা হাসপাতালে মাকে নিয়ে কয়েকটা দিন অমানুষিক যুদ্ধ করি। বাসায় আসলে আইসোলেশন হবে না দেখে, হসপাতালেই থাকতাম। একটা মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি শুধুমাত্র তীব্র ভয়ের কারণে কারন তখন লাশ দাফন নিয়েও খুব জটিলতা চলছিল। আত্মীয়-স্বজনরা বাসায় খাবার রান্না করে বাইরে রেখে দিয়ে যেতেন। যাই হোক মিরাকুলাসলি বাবা মা দুজনেই সুস্থ হলেন। বাসায় নিয়ে আসলাম। সব ঠিকঠাক হলো।”

আমি: “তারপর ?”

মেয়েটি: ” কিন্তু ম্যাডাম প্রবলেমের শুরু হল এরপর থেকে যখন সবকিছু সেটেল হয়ে গেল। এখন আমি কোন জোরে শব্দ নিতে পারিনা। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলেই দুই হাতে কান চেপে রাখি। আমার প্রচন্ড বুক ধরফর করে। গলা শুকিয়ে যায়। ‌ ঘাম হতে থাকে। আমি হাঁপাতে থাকি। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যায়। এমনকি আমি যেই হসপিটালে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছি, সেখানে ডিউটিও আর করতে পারছি না। রোগী দেখলেই আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই না ইদানিং আমার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। অকারনে ভয় লাগছে। দুঃস্বপ্ন দেখছি। কিছু মনে রাখতে পারছি না। এমনকি সেদিন রিকশাওয়ালাকে দুইবার ভাড়া দিয়েছি‌ বলে রিক্সাওয়ালা টাকা ফেরত দিয়েছে। “

আমি : ” এটাকে কি তুমি এ্যজ এ ডক্টর প্যানিক অ্যাটাক বলতে পারো?”

মেয়েটি: ” জ্বী।”

তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।

বিশ্বব্যাপী একটা ক্রান্তিকাল চলছে। এই অস্থিরতার কোভিড-১৯ প্যানডেমিক একটা সময় পরে স্থিতি লাভ করবে। পুরাতন মহামারীগুলোর স্থায়িত্বকাল বিবেচনা করে গড়ে দেখা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে প্যানডেমিকের অস্তিত্ব ১৮ মাসের মত থাকে। করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ওয়েভ মানব সভ্যতাকে ইতিমধ্যেই আঘাত করেছে। বাংলাদেশে সম্ভবত একটু পরে শুরু হওয়ায় জুনের দিকে দ্বিতীয় ওয়েভ হয়তো ধাক্কা দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেটা ভবিষ্যৎবাণী করেছে প্যান্ডেমিক পরবর্তী তৃতীয় ওয়েভের ধাক্কাটা যাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।

এই মেয়েটা তারই ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের প্যানিক অ্যাটাকে সাইকোথেরাপি চমৎকার কাজ করে। তবে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে ভাবাটা যুক্তিযুক্ত নয়। বেশকিছু সেশন লাগবে।

মানুষের মনোভূমি বড় বিচিত্র। যারা, অন্যরা কোন কারনে মানসিক দুর্বলতা এবং কষ্টে ভুগছেন, দেখে তাদেরকে বুলি করেন না বরং সাহায্য করতে পারুক বা না পারুক, শান্তভাবে তাদের কষ্টের কথাগুলো শুনেন, কথাগুলো বলার নিরাপদ ( পরবর্তীতে এই নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন না বা অপমান করেন না) সাহস দেন এ ধরনের মানুষদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।