কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
পর্ব-২১
মেয়েটির বয়স অল্প। চেম্বারে এসেছে। সাথে স্বামী। প্রারম্ভিক কুশলাদির পরে বললাম, “কথা কিন্তু আমি ওনার সাথে একা বলবো।”
ভদ্রলোক ওয়েটিং এরিয়াতে বসতে যেয়ে ইশারায় আমাকে বললেন, ” আমি যদি আপনাকে না জানাই আপনি চিকিৎসা কিভাবে শুরু করবেন? বুঝবেন না, ও তো আপনাকে সব সত্যি কথা বলবে না। “
আমি বললাম,” আগে ওর কথা শুনবো, সমস্যা যেহেতু তাঁর তাই অন্যের কাছে কিছু শুনলে বায়াসড হবো হয়তো।”
তির তির করে কাঁপছে মেয়েটার চোখের পাতা। চোখে চোখে রাখছে না। এসি চলছে। তার মধ্যেও ঘেমে-নেয়ে একসা।
আমি বললাম, ” ফ্যান চালাব?”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিল।
বললাম : “পানি খাবেন?”
বললো : “খেয়ে এসেছি।”
বললাম, ” আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি আপনার কনফিডেনশিয়াল কথা আমি জানাবো না। আপনি কি নিজে এসেছেন নাকি আপনাকে জোর করে এনেছে?”
চোখের পাপড়ির কাঁপন দ্রুততর হচ্ছে।
আমি বললাম, “চা খাবেন?”
মেয়েটি, ” খাই না।”
আমি, ” কখনোই খান না?”
মেয়েটি, ” আগে খেতাম, এখন খাই না ফালতু খরচ করে কি লাভ?”
আমি, “আসেন আমরা চা খেতে খেতে গল্প করি, সময় পার হলে আপনি বের হয়ে যাবেন।”
মেয়েটির প্রথমবারের মতন আমার চোখে চোখে তাকালো। বেশ অনেকক্ষণ চোখে চোখ রাখল। আমি হাসলাম।
বললাম, “এখানে যারা আসেন আমি সবার কথা শুনি, কেউ আমার কথা শোনেন না, নিজের কথা বলতে ব্যস্ত, আজকে আমার ভীষণ মন খারাপ,
শুন্য থেকে দশ গুণলে আজ দশেদশ মন খারাপ। মজার কথা হল দশে ছয় পর্যন্ত শোনানোর মানুষ আছে। তারপর আমি আর কিছু বলতে পারি না। আপনি সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও, আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে। এই প্রথম কেউ আমার এত বেশি মন খারাপের কথা শুনছে, তাই আপনার সম্মানটা আমি রাখবো, ভয় পাবেন না।”
মেয়েটি কেঁদে ফেলল। আস্তে আস্তে মুখ খুলল। শ্বশুরবাড়ির দেয়া প্রচন্ড মানসিক নির্যাতনে post traumatic stress disorder (PTSD) তৈরি হয়। নিজের অপ্রাপ্তির বঞ্চনায় ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে না পেরে এরপর যাচ্ছে তাই ভাবে রাগারাগি, বিশ্রী ভাষায় চিল্লাচিল্লি, তুচ্ছ কারণে ভাঙচুর এমনকি কান্নাকাটিসহ অনেক কিছুই করে।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
মানুষ যখন তার আসল অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারে না তখন অন্য কোন একটা অনুভূতি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। মেয়েটা ছিল প্রচণ্ড দুঃখী। কারণ তার স্বামী নিজের মা, বোনের প্রতিটি কথায় কথায় বিশ্বাস করত। মেয়েটিকে শোধরাতে চেষ্টা করত। স্ত্রীর অযত্ন কিন্তু স্বামীটি কখনোই করেননি। ফলে,মেয়েটির বাপের বাড়িতেও একসময় বলে”স্বামীতো ভালোবাসে তবে এত সমস্যা কেন?” বন্ধুদের সাথে বহু আগে থেকেই বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে বিয়ের পরে পরেই। ধীরে ধীরে মেয়েটি যতই চেষ্টা করতে থাকে শ্বশুরবাড়িতে এডজাস্ট করবার, তার প্রতিটি অসফল প্রচেষ্টা তার ভেতরে missing acceptance তৈরি করতে থাকে। ধীরে ধীরে বৈরিতা বাড়তে থাকে। একটা সময় তার মনে হতে থাকে এই ঘর সংসার, এই স্বামী, কিছুই তার আপন নয়। এত অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাইগ্রেইন, কোমরের ব্যথা, কপালের বলিরেখা, চুল পাকা সবকিছু নিয়ে জবুথবু হয়ে যায়। তার উপরে ইদানীং যুক্ত হয়েছে মেয়েটাকে পাগল বলা। শাশুড়ি বলা শুরু করেছে,
“পাগলের সাথে ঘর সংসার করা ধর্মীয়ভাবে নীতিবিরুদ্ধ।”
নিদৃষ্ট সময় শেষে আমি স্বামীকে ডেকে মেয়েটির সামনে বললাম, “মানুষের শরীর যখন আইসিউতে যায়, সেটা সবাই দেখতে পায়। কিন্তু মনটা আইসিউতে গেলে সেটা বোঝানো যায় না। এই মেয়েটা মনে মনে মারা যাচ্ছে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ না। সমাজের যেটা পাগল বলে লেবেলিং করে সেটা অবশ্যই আমি করবো না। ও শুধু আর নিতে পারছে না। তাই আইসিইউ রোগীর যেমন যত্ন দরকার ডাক্তার, নার্স, বাড়ির মানুষ সবার মিলিয়ে, তেমনি এই মেয়েটার যত্ন দরকার আপনার, আমার, বাড়ির মানুষ সবার সহযোগিতা মিলিয়ে। ওকে বেশ কিছু দিন আমার কাছে আসতে হবে যদি তার মন চায় এবং প্রতিবারই আমি একা কথা বলবো। সাথে যেটা না বললেই নয় সেটা হল অবশ্যই আপনাকে ধন্যবাদ কারণ আপনি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন প্রফেশনাল সাহায্যের জন্য , ওকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন প্রথম দিনের পরে আমাকে বাদ দিয়ে ও যদি অন্য কারো সাথে কথা বলতে চায় আমি রেফার করে দেবো তবে কারো না কারো কাছে যাওয়াটা ওর জরুরি। “
হত্যাকাণ্ড দু’রকম হয়। একটি শারীরিক যার প্রকাশ্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আরেকটি মানসিক, যার কুশীলবরা পর্দার অন্তরালে ভালো মানুষের মুখোশ পরে সমাজে ঘুরে বেড়ায়। আপনার আমার সাথে চা খেতে খেতে গল্প করে। যারা মানুষকে মানসিকভাবে অত্যাচার করতে করতে অদৃশ্যভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন না তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা আর সম্মান।
পর্ব-২২
“ইস ডক্টর ! আপনি যত চমৎকার করে কথা বলেন, কি সুন্দর করে আমার সমস্যাটা বুঝলেন, আমার বউটা যদি এরকম করে আমাকে বুঝতো, তাইলে আমাদের কোনো কষ্টই থাকতো না।” ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে হবে। মার্জিত উচ্চারণ, সুরিয়ালিজম থেকে ব্যোমকেশ বক্সীর উদাহরণ, পোশাকের পারিপাট্য সবকিছুতেই উচ্চশিক্ষা ও সুরুচির ছাপ। জীবনে যা যা চেয়েছে অর্থ-সম্পদ, যশ, খ্যাতি জীবন দুই হাতে ঢেলে দিয়েছে।
কিন্তু ইদানিং প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগছেন। জীবনটা পানসে হয়ে গেছে। একঘেয়েমি কাটাতে নতুন কেনা কোটি টাকার গাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে হুট করে ঘুরে আসেন কক্সবাজার। যেন উঠল বাই তো কটক যাই। পোশাকের জৌলুস আর অর্থের প্রাচুর্য যত বেড়েছে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নারী সঙ্গিনী। স্ত্রীকে দেবীর আসনে বসিয়ে, আজ ঘরওয়ালী ও বাহারওয়ালীর যৌথ সঙ্গত তিনি করতে শিখেছেন। তাই স্ত্রীর সাথে সহবাস (এক ছাদের তলায় বসবাস) হলেও সহবাস হয় না। ডিপ্রেশনের ক্লাসিকস সাইন (বেশী ঘুমানো, ক্ষুধা মন্দা, গা ম্যাজ ম্যাজ করা) যতো বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে ঠিক ততটাই বেড়েছে কেবিনেটে মদের বোতল। ইদানিং প্রায়ই তিনি প্রথম প্রেমের নস্টালজিক গল্পে বিভোর থাকেন।
এরপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোকের কথার উত্তরে বললাম, “আপনি মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগবে। কিন্তু সবচেয়ে আগে দরকার বদঅভ্যাসগুলো থেকে বের হওয়া। যে চোখের ইঙ্গিতে আপনি পরকীয়া করেন, সেই চোখের ইঙ্গিত যদি আমার দিকেও দেন, তাহলে আপনার সেশন কিভাবে নেব?”
আমাদের সভ্যতার চাকা যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ ততই ক্রমাগত নিঃসঙ্গ হয়েছে, ব্যাপক সংখ্যক মানুষ ইদানিং এই মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে। পরকীয়া এর সমাধান নয়। জীবনসঙ্গীর সাহায্য নিন, মেন্টাল হেলথ প্রফেশনালের সাহায্য নিন। এর থেকে বের হতে কয়েক বছর সময় লাগে। লাইফ-স্টাইল মডিফিকেশনই একমাত্র মুক্তির উপায়।
জীবনের ধাপে ধাপে এমন হতেই পারে। সমস্যা থাকবেই। তবে সমস্যার সম্মানজনক সমাধানের উপায় খুঁজে বের করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যারা ঘুরে দাড়াতে পারেন তাদের জন্য অনেক সন্মান ও ভালোবাসা।
পর্ব-২৩
কিছুদিন আগে তিনি সেশনে এসেছেন। কথা প্রসঙ্গে একপর্যায়ে বললেন, ” ভালোবাসাটাই আমার জীবনে একটা অভিশাপ ।”
ওনার কথায় মনে পড়ল ছোটবেলায় রচনা পড়তাম, ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ।’ পুরোটাই নির্ভর করছে ব্যবহারের উপর।
তারপরে সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আমি বললাম, “কাউকে ভালোবাসাটা কঠিন কিছু না, যদু মধু কে , রহিম রহিমা কে , পল পলিকে ভালোবাসতেই পারে। কিন্তু সমস্যা হলো যেই commitment ও আবেগ দিয়ে ভালোবাসছিলাম সেই মমত্ব শেষদিন পর্যন্ত মানুষ ২টি ধরে রাখতে পারলো কিনা! ভালোবাসার বৃত্তে একই বিন্দুতে তারা পরস্পরকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো কিনা? কারণ কক্ষপথ চ্যুতি কখনো কখনো অস্থির সময়ের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায়.”
হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্প পড়েছিলাম, পাখি উড়ে গেলেও পালক পড়ে থাকে। ‘উইড়া গেল সোনার পঙ্খী পইড়া রইলো পালক।’ এই পালকটিকে উনি মায়া বলেছিলেন। বিয়ের প্রথম দিককার উন্মাতাল ভালোবাসা হয় কিন্তু একটি নিউরোলজিক্যাল কেমিক্যাল endorphine এর জন্য। আস্তে আস্তে কেমিক্যাল সিক্রেশন কমে যায়। ফলে হানিমুন পিরিয়ডও মোটামুটি ছয় মাস থেকে দেড় দুই বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু যতদিন যায় মায়া বাড়ে। এই মায়াই আগলে রাখে সম্পর্কটাকে; আটকে রাখে মানুষ দুটিকে।
জীবন সঙ্গীর প্রতি মায়া আর শ্রদ্ধা যদি থাকে, অস্থির চোখের পলকে হারানো ভালোবাসা না থাকলেও জীবন চলে যাবে। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার মতন, প্রতিদিন স্নানের জন্য আমাদের ঘটির জলই দরকার হয়।
যারা জীবনসঙ্গীকে শ্রদ্ধাভরে মায়া করেন, তাদের অবচেতন মনে ভালোবাসার নদীর ফল্গুধারা গোপনে বহে নিরবধি( আসিফ মেহদী র গল্পের মত) । তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
পর্ব-২৪
স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর। কাপল কাউন্সেলিংএ এসেছে। নিয়মমতো প্রথমে দুজনের সাথে আলাদা আলাদা করে বসলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দুজনেরই প্রথম কমপ্লেইন পরস্পরের শ্বাশুড়ি সবকিছুতে ইন্টারফেয়ার করে। দুই মায়ের মতামত এতই তুমুল, যে দম্পতির নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবগুলো বলার সুযোগ নেই।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
স্বামী-স্ত্রীর প্রথমেই দুটি জিনিস দরকার,
প্রথমটি হচ্ছে বিয়ের জন্য কত টাকার কাবিন হবে, ওয়েডিং ফটোগ্রাফার কে হবে, মেকআপ কি হবে, মেনু কি হবে, সেটা ঠিক না করে অতি জরুরি হলো একটা রুল সেট করা; যে আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমাদের পারস্পরিক বিষয়ে,
*কতটুকু ফ্যামিলিকে বলবো?
*কতটুকু ফ্যামিলিকে ইনভলভ করব?
*নিজেদের সম্মানটা কিভাবে উভয় পরিবারের কাছে রাখবো?
এখানে যদি একটা ক্লিয়ার বাউন্ডারি সেট না হয়, তবে কিন্তু এই কথাগুলো আসবে যেমন,
*স্বামী/ স্ত্রী তার মায়ের কথায় চলে,
*বোনের বুদ্ধিতে চলে,
*বাপের উপর দিয়ে কথা বলতে পারেনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে আমরাই কিন্তু অন্যকে নিজেরাই দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকাই। নিজেদের যে একটা পার্সোনাল স্পেস প্রয়োজন, নিজেদের সমস্যা যে নিজেদের সমাধান করা সম্মানজনক, কারণ এখন আমরা কাপল, এটা মনে রাখা দরকার। পরিবারের হস্তক্ষেপ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাই তৈরি করে সেটা ভুলে যাই।
২জন অ্যাডাল্ট মানুষের ক্ষমতা আছে নিজেদের সমস্যাগুলো সলভ করার। প্রয়োজনে ম্যারেজ কাউন্সিলরের সাহায্য নিন। কারণ তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বলবেন। অথচ যার যার বাড়ির লোক তার নিজ পক্ষের দিকে টেনে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। তাই না?
দ্বিতীয়ত এটাও খেয়াল করা দরকার আমি আমার সঙ্গীর কাছে যদি আনন্দ চাই আমি কি সেই আনন্দটা তাকে দিচ্ছি? আমার দেয়ার জায়গাটা কি ঠিক আছে? সম্মানটুকু যে চাচ্ছি সেই ফিরতি সম্মান কি সে আমার কাছ থেকে পাচ্ছে?
জীবনসঙ্গীকে খোঁচানোর আগে, দোষারোপ করার আগে, একবার ভাবুন তো, এতো যে চাই চাই করি, বিনিময়ে আমার থেকে কি কি সে পাচ্ছে? তাকে ভালো রাখা কিন্তু আমার নিজের জন্য দরকার। কারন সে ভালো থাকলে সেও আমাকে ভাল রাখবে। আমরা ভালো থাকবো।
ঝগড়া কিন্তু একজনে হয় না। এক হাতে তালি বাজে না। এই ঝগড়াতে আপনার কন্ট্রিবিউশন কি? একটু খেয়াল করুন তো আপনার কোন আচরণ ঝগড়া বাড়াচ্ছে কিনা?
তবে একজন চেষ্টা করেই যাচ্ছে নিজেকে বদলাতে, অন্যজনের কোন চেষ্টাই নেই; এটা কিন্তু রেড ফ্ল্যাগ। আপনি গলা পানিতে নামলে, অন্তত অপরজনকে তো হাঁটু পানিতে নামতে হবে। যদি না করে তবে কিন্তু সাবধান। বিয়ে একটা দলিলবদ্ধ সম্পর্ক। হিসেব-নিকেশগুলা তবে মিলানো শুরু করুন। তেলে জলে আপনি যতই ঝাঁকান মিশ খাবে না।
যারা নিজ দাম্পত্যের কথা, নিজেদের মধ্যেই সমাধান করে, প্রযোজনে পরিবারকে ইনভলভ না করে প্রফেশনাল সাহায্য নেয়, তারা পরিবারে নিজের সম্মানটুকু টিকিয়ে রাখে। এই সম্মান টিকিয়ে রাখা মানুষগুলিকে স্যালুট।
পর্ব-২৫
ভদ্রমহিলার বয়স ৫৬। একটি মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান। হুলুস্থুল জমজমাট চেম্বার। ছেলে ও ছেলের বউ সহপাঠি, বিয়ে হয়েছে বছরখানেক।
ভদ্রমহিলা আমাকে বলছেন,”আমার ছেলের বউ যখন বলে আমি প্রতি পদে পদে তার ভুল ধরি, আমার কেমন লাগে? আমার কি অধিকার নেই ওদের ভুল দেখলে শুধরে দেবার? ওরা ছোটমানুষ কি এমন বোঝে দুনিয়াদারীর? একটা অফিস চালানোর কি ঝামেলা সেটা আমি জানি। ওরা কখনো বাইরের পৃথিবীর আঁচতো সহ্য করেনি। বৌমা অন্তঃসত্ত্বা, মার বাসায় আছে, সন্তান নিয়ে ফিরে নাকি আলাদা বাসায় উঠবে। ইদানিং ছেলেও বউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলছে, মা তোমার দোষ।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলে গল্প।
আমার ছেলে বা মেয়ে নতুন দম্পতি হলে অনেক কিছুই তারা প্রথমে প্রথমে বুঝবে না। কারণ এর আগে তো বিয়ে করেনি। ফলে তারা দাম্পত্য সমস্যায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সেই ক্ষেত্রে আমি আসলে কতটুকু ইনভলভ হবো, আদৌ হবো কিনা, সেটা আমাকেই ভাবতে হবে।
ধরুন ছোটবেলায় যখন আপনার ছেলেকে অংক শিখিয়েছেন, তখন তাকে অনেকবার আপনি যোগ অংক করিয়াছেন। কারণ যত বেশি সে প্রবলেম সলভ করেছে ততো অংক করতে তার দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক সেরকম দাম্পত্যজীবনেও সে যত সমস্যা নিজে নিজে সমাধান করবে তার দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা করার দক্ষতা ততই বৃদ্ধি পাবে।
এখন প্রশ্ন হলো আপনি কি তাকে সেই সুযোগটি দিচ্ছেন? নাকি হুট করে প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান করতে নিজেই এগিয়ে আসছেন? একটু খেয়াল করে দেখুন তো আপনার এই এগিয়ে আসা কি আসলেই সমাধান তৈরি করছে?
দাম্পত্য কলহ পরিবারের একটি ক্ষত। পরিবারের একজন মুরুব্বী হিসেবে হিসেবে এই ক্ষত সারাতে আমি ভূমিকা নেব, এই ভাবনাটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি এটাও ভাববো, এই কনফ্লিক্ট তৈরিতে আমার রোলটা কী?
আমি সিমপ্যাথাইজ হয়ে নিজের frame of reference থেকে বুদ্ধি দিচ্ছি, এটা কিন্তু কাপলদের মধ্যে dissatisfaction তৈরি করতে পারে। কারন কাপলটিও অ্যাডাল্ট; ওদের মতামত এবং চাহিদা আলাদা।
আজকে আপনি বলছেন আপনার ভালবাসার জায়গাটা থেকে, সন্তান বা ভাই বা বোন ভেবে, কিন্তু তাদের খারাপ লাগার জায়গাটা হয়তো অন্য। পরে একটা সময় তারা আপনাকে ব্লেইম করতে পারে। এটা কিন্তু আপনার কষ্ট তৈরি করবে।
অনেক সময় পাছে লোকে কিছু বলে ভাবতে যেয়ে ফ্যামিলি দুটো মানুষের অনুভূতি এবং চিন্তাকে পাত্তা দেয় না। স্পেশালি এবিউসিভ রিলেশনশিপে। তখন কি এই যুগেও কাদম্বিনী আবার মরিয়া প্রমাণ করিবে যে সে মরে নাই?
সবাই কিন্তু নিজের পায়ের মাপের জুতা দিয়ে কথা বলবে নট নেসেসারি যে সে অন্যের সমস্যাটা তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝবে। কাজেই প্রয়োজন হলে আপনি নিজে ইনভলভ না হয় ওদের ম্যারেজ কাউন্সিলর এর কাছে পাঠান।
আমি ভদ্র মহিলাকে প্রশ্ন করলাম, ” আজকে যার দোষ ধরছেন, এই ছেলের বউটির কখনো কী তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করেছেন?”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ” ওর তো ভালো কোন গুনই নাই।”
আমি বললাম ” ঝগড়া কিন্তু একজন এ হয়না। এক হাতে তালি বাজে না। এই ঝগড়াতে আপনার কন্ট্রিবিউশন কি ? আপনার কোন আচরণ ঝগড়া বাড়াচ্ছে কিনা?”
যারা দুটো পূর্ণবয়স্ক মানুষের বিচার বিবেচনার উপর আস্থা রাখেন; তাদের জন্য অনেক শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা।
পর্ব-২৬
প্রেমের বিয়ে। দুইজনেই পেশাজীবী, উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত এবং মানবিক। শ্বশুর,শাশুড়ি, দুই বাচ্চা আর এই দম্পতি, বিশাল এক বাড়িতে থাকে।
ভদ্রলোক বললেন, “আমাকে প্রতিদিন না হলেও একদিন পর পর শুনতে হচ্ছে, আমি আমার স্ত্রীকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও অধিকার দিচ্ছি না, এমন কি বুঝতেসি ও না। কারন, আমার স্ত্রীর একমাত্র চাওয়া আলাদা হওয়া। সে, আমার বাবা – মা সাথে থাকতে পারছে না।”
ভদ্রমহিলার মন্তব্য, ” আমি আর পারছিনা, আমাকে তো বাঁচতে হবে। আমি নিজে জয়েন্ট ফামিলি তে বড় হয়েও, এই মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না, ওরা কেউই আমার ভেতরের কষ্টটা বুঝতে পারছে না, এমন কি আমার বাবা মা’ও না।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
প্রত্যেকটা পরিবারের একটা গ্রুপ ডায়নামিকস থাকে। ঠিক যেরকম ছোটবেলায় খেলার সময় আমাদের ছোট ছোট দলে থাকতো। এই পরিবারটিতে, দম্পতি একটি দল, শ্বশুর-শাশুড়ি একটি দল, আবার মা ছেলে একটি দল, বাচ্চাগুলো দল গঠনের জন্য এখনও বেড়ে উঠেনি, তবে দুধ ভাতের মত বিভিন্ন দলে তাদের টেনে নেওয়া হয়। সবচেয়ে এলার্মিং কথা হল, দিন শেষে যে যেই দলে খেলুক না কেন, পরিবারটির প্রত্যেকটি মানুষ ভয়ানক নিঃসঙ্গ বোধ করেন। এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত, একই ছাদের তলায় দিন যাপনের গ্লানি তাদের ক্লান্ত করে তুলছে।
যেখানে বিত্তের আর চিত্তের বিনোদনের অভাব নেই; লক্ষ্মী আর স্বরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য একটি পরিবার সেখানে কি এমন ঘটে যেখানে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরো পরিবারটি বিধ্বস্ত বোধ করছে?
মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই ঘটনাটাকে আমরা গেম বলি। “99% people 99% time play game.”
ইন্টারেস্টিং কথা হল, এই গেম কিন্তু আমরা সচেতনভাবে খেলি না। খেলি অবচেতনভাবে।
এখন কিভাবে বুঝবো যে আমি গেম খেলছি?
ঘটনাটা এমন হবে, ধরুন খুব সাধারণভাবেই যেকোনো বিষয়ে কথা শুরু হবে দুজনের মধ্যে। কথা চলতে চলতে একটা জায়গায় এসে ঠাস করে একটা খটকা লাগবে উভয়ের। দু’জনই ফিল করবে যে একটি নেতিবাচক অনুভূতি বাড়ছে পরস্পরের প্রতি (এই তিনটি অনুভূতির যেকোনো একটি, সেটি হচ্ছে রাগ নয় তো দুঃখ নয় তো ভয়)। এরপর পারস্পারিক কিছু বাঁকাচোরা কথা হবে। তীর ছোড়াছুড়ি হবে। তারপর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে দুজনই নেগেটিভ একটা ফিলিংস নিয়ে কথা বন্ধ করে দিবে। এবং ভাববে একই নাটক আবার মঞ্চস্থ হল। বারবার একই বৃত্তে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।
এই ঘটনাটা দিনের পর দিন বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ঘটতে থাকবে। আজকে শাশুড়ি, কালকে অফিসের কাজ, পরশুদিন দুধওয়ালা, তারপর দিন কাজের মেয়ে, তারও পরে বাচ্চার হোমওয়ার্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।
খেয়াল করবার বিষয় হলো, প্রতিটা গেমের পরেই, হয় আপনি রাগ করবেন নয়ত দুঃখ পাবেন, অথবা ভয় পাবেন। ঘুরেফিরে এই তিনটা অনুভূতির যে কোনো একটা অনুভূতি বারবার প্রতিটা গেমের পরে আপনাকে আঘাত করবে। এইটাকে পে অফ বলে। ধীরে ধীরে এই আঘাতের তীব্রতা বাড়বে। আপনার সহ্য ক্ষমতা কমে যেতে থাকবে। একটা সময় মনে হবে, সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় নেই।
এইখানে এই ভদ্রমহিলার যেটা হয়েছে, সেটা হল রাগ। উনি কিন্তু আদতে আলাদা হতে চান না। আলাদা হতে চাচ্ছেন বলে ওনার ভেতরে গিল্টও কাজ করে। সেটা উনি প্রকাশও করতে পারেন না। কিন্তু মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, তখন সে মরতে চায় না, শুধু সে জানেনা তার পেইনটা আর অন্য কোন উপায়ে কমানোর পন্থা কি? তাই নিরুপায় হয়ে সে আত্মহত্যা কে বেছে নেয়। ঠিক এই ভদ্রমহিলাও জানেন না, এই গেমের নেগেটিভ পে-অফগুলো থেকে বের হয়ে আসার পন্থা কি? অগত্যা বিপর্যস্ত মনে তিনি ভাবছেন সংসার আলাদা করলেই হয়ত তিনি রেহাই পাবেন।
এই গেম এর ফলে প্রাপ্ত মানসিক আঘাতগুলো এতই তীব্র এখন, ভদ্রমহিলা ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার ইত্যাদিতে শারীরিকভাবে ভোগা শুরু করেছেন। স্ট্রেস কিন্তু এই অসুস্থতাগুলোকে বাড়িয়ে তুলে।
কাজেই আলাদা হওয়াটা সমাধান নয়। গেম খেলাটা বন্ধ করাটা সমাধান। কারণ আলাদা হলেও অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে তখনও গেম চলতেই থাকবে। show must go on।
আমরা প্রত্যেকটা মানুষ গেম খেলি। সচেতনভাবে না, অবচেতনভাবে। Formula G আছে এই গেম বুঝতে। না হলে সাইকোথেরাপিস্ট আছেন। তাই আমি গেম মুক্ত হব পরিবারকে ভালো রাখার জন্য না, আমি গেম মুক্ত হব নিজেকে ভালো রাখার জন্য। আর কে না জানে আমি সুস্থ মনে, সুস্থ শরীরে থাকলে আমার পরিবারও ভালো থাকবে।
যারা নিজের পরিবারকে আগলে রাখেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-২৭
বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক পারিবারিকভাবেই। রূপকথায় যে ধরনের সব ভালো, সব ভালো রাজপুত্র রাজকন্যা খুঁজে, ছেলে মেয়ে দুজনই একদম সেরকমই। এককথায় রাজযোটক।
এই দুই বছরে, কখনোই তাদের যৌন সম্পর্ক হয়নি। তারা একই ছাদের তলায় সহবাস করলেও আক্ষরিক অর্থে তাদের বিবাহিত জীবনে সহবাস হয়নি।
মেয়েটি দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে, অবশেষে বাবা মাকে জানিয়েছে। প্রথমে যদিও মেয়েটিকেই দোষ দিয়েছে সবাই যে সে স্বামীকে কিভাবে সুখী করতে হয় সেটা জানে না। তারপর দুই পরিবার এখন লজ্জার মাথা খেয়ে, ভাবছে কাউন্সেলিং করলেই বিয়েটা টিকে যাবে।মেয়েটার কেমন লাগছে সেটা ভাবার থেকেও, উভয় পরিবারের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো, পাছে লোকে কিছু বলে।
মেয়েটি বলছে, ” আমি কি বিয়ের আগে শিখে এসেছি? আর কি করতে পারি বলেন? ওই জঘন্য পর্নোগ্রাফি সিনেমাগুলোর মতন, কুৎসিত পোশাক পরেও হাজবেন্ডের কথা মতো অভিনয় করেছি। শরীরে খালি মারের দাগই বেড়েছে। আর কিছু হয়নি, ও’কি কোনো মানুষ আছে? আগে তো তাও রেখেঢেকে দেখতো, এখনতো ওপেনলি ঘরের মধ্যে দেখে। আগে একটা স্ক্রিনে দেখতো, এখন আরো স্ক্রীন যোগ করেছে তার সাথে। “
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ব্রেইন স্ক্যানে দেখা গেছে পর্নোগ্রাফি ড্রাগ অ্যাডিকশনের মতই তীব্র।
পর্নোগ্রাফিক কি করে?
আমাদের ব্রেইনে একটা রিওয়ার্ড সেন্টার আছে। পর্নোগ্রাফি ওই জায়গাটাকে উত্তেজিত করে। ফলে ব্রেইনে কিছু কেমিক্যাল তৈরি হয়। এবং পরেরবার সমপরিমাণ মনোদৈহিক ভাবে উত্তেজিত হতে আরো বেশি পরিমাণ পর্নোগ্রাফি দেখতে হয়। ঠিক ঘুমের ওষুধের মতন, আস্তে আস্তে যত ব্যবহার করবো ততই ডোজ বাড়বে। এবং ছেড়ে দিলে withdrawal symptom হবে।
আশঙ্কার কথা হল ব্রেইনের একটা অংশ পর্নোগ্রাফি দেখলে ছোট হয়ে যায়। ব্রেইনের যে জায়গাটায় রিওয়ার্ড সেন্টার থাকে এবং মোটিভেশনে উদ্দীপ্ত হয়ে সেই অংশটাই যত বেশি পর্নোগ্রাফি দেখব আস্তে আস্তে সংকুচিত হতে থাকবে।
আগে বিজ্ঞানীরা বলতেন, শৈশবের একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ব্রেইন ডেভলপমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। এখন বলছেন ব্রেইন পরিবর্তিত হয় আমরণ। ব্রেইন আসলেই দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করতে এবং নতুন অভ্যাস তৈরি করতে সক্ষম। নতুন অভ্যাসে ধরেই আসক্তিগুলি তৈরি হয়।
স্বাভাবিক দুটো মানুষের সাথে যৌন সম্পর্কর থেকে এর পার্থক্য হল, এখানে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে অক্সিটোসিনের বন্ডিং হয় না। ফলে তার ব্রেইন বুঝতে পারে না যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দুটো মানুষ দরকার। ব্রেইন এখানে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে একটি অভিজ্ঞতার সাথে যেটিকে সে পর্নোগ্রাফি ভিডিও অথবা ছবির মাধ্যমে নিচ্ছে। কাজেই যৌনসম্পর্ক স্থাপনের যেটা বেসিক কনসেপ্ট, একজন পার্টনারের উপস্থিতি, এখানে সেটা থাকেই না। তাই পার্টনারের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মানবিক আচরণ এখানে অনুপস্থিত থাকবে। পর্ণ আসক্ত ব্যক্তি, শারীরিকভাবে পার্টনারকে আঘাত করবে, কুৎসিত গালাগালি করবে এমনটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে।
যত বেশি পর্ন দেখব তত বেশি মস্তিষ্ক আরো চাইবে। ক্ষুধাটা আরো বাড়বে। আরো বেশি বিকৃত দৃশ্য এবং ছবি প্রয়োজন হবে সেই মানুষটির ভেতরে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিতে। এটা বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে যাবে যখন চাইলেও স্বাভাবিক যৌন জীবনের ফেরাটা মুশকিল হয়ে যাবে।
পর্নোগ্রাফি অ্যাডিকশন থেকে মুক্তির উপায় কি? পর্নোগ্রাফি অ্যাডিকশনে, সাইকোথেরাপি চমৎকার কাজ করে তবে সময় লাগবে। প্রয়োজনে কিছু ওষুধের সাহায্য নেয়া যায়। কিন্তু সবার আগে বোঝা প্রয়োজন যে এই জিনিসটা ক্ষতিকারক। এর থেকে “বের হয়ে আসতে চাই” এই সদিচ্ছা থাকলে, অবশ্যই এই অ্যাডিকশন এর হাত থেকে রেহাই মিলবে।
যারা অ্যাডিকশন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
পর্ব-২৮
বাচ্চাটার বয়স ১১ বছর। বাবা মা দুজনেই উচ্চপদস্থ। ইদানীং ঘুরতে গিয়েছিলো ফ্যামিলি ট্রিপে। সব কাজিনরা ছিল। বাচ্চারা রিসোর্ট এ একই রূমে রাতে ছিল, সেখানেই দেখা গেলো, সে মাস্টারবেশন করেছে। পরদিন নাস্তার টেবিলে এই গল্প চাচা, ফুপু, দাদা দাদী সবার মদ্ধে চাউর হলো।
তিন দিন পরে উদভ্রান্ত বাবা, মা আমার চেম্বারে করুন কণ্ঠে বললো, ” নাম করা স্কুলে পড়াই, এই বয়সে, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া ঘুরিয়ে এনেছি যাতে কসমোপলিটন কালচার বোঝে, গ্লোবাল সিটিজেন হয়। এই তার পরিণতি !!!”
তারপর কাউন্সেলিং
পর্ব-২৯
কিছু কিছু মানুষের মুখের অনুচ্চারিত কথা চোখ বলে। চোখ মনের আয়না। ব্রেইনের সাথে রেটিনা সরাসরি স্নায়ু সংযোগ হওয়ায়, ব্রেইনের চিন্তা চোখে প্রতিফলিত হয়।
মেয়েটির চোখ অসম্ভব সুন্দর। ডাগর চোখ দেখে মনে হয় বলি “চঞ্চল চোখের তারা”। তদের বিয়ে হয়েছে ৯ বছর, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ১৪ বছর। বিয়ের সময় মেয়ের বয়সও ছিল ১৪ বছর।
খুব অবাক হয়ে, বললাম আপনাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে? স্বামী লাজুক হেসে বললেন, ” পারিবারিক বিয়ে তো, বুঝেনতো।” বুঝলাম বুঝে নেয়ার দায়ভার একান্তই আমার। মেয়ের আজ একুশে পা।
এই দম্পতি ‘কাপল কাউন্সেলিং’ এ এসেছে।
স্বামীর কমপ্লেইন, ” স্ত্রী বারবার পরকীয়ায় জড়ায়। “
স্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি, ” আমি নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারি না।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
মেয়েটির বাবা মায়ের সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ছিল। ছোটবেলা থেকে, মায়ের কাছে বাপের বদনাম, বাপের কাছে মায়ের বদনাম শুনে শুনে বাবা-মা’র কাউকেই মেয়েটি শ্রদ্ধা করতে শেখেনি। রজস্বলা হওয়ার আগেই ক্লাস ফাইভেই প্রেমে পড়ে যায় পাড়ার এক বখাটের। কারণ ছেলেটি মেয়েটিকে অ্যাটেনশন দিয়েছিল, এই জিনিসটাই সবচেয়ে কমতি ছিল মেয়েটির পাওনার খেরোখাতায়।
তারপর মেয়েটি সিক্সে পালিয়ে গেল মহল্লার দোকানদারের সাথে। এতকিছুর পরেও রেজাল্ট ভাল হওয়ায় বাবা-মা জোর করে ক্লাস সেভেনে পাঠিয়ে দিলো হোস্টেলে। নিয়মকানুন সহ্য করতে না সেখান থেকেও পালিয়ে এলো। ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বড় মেয়ের সাথে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো।
গত ৯ বছরে বহুবার পরকীয়ায় জড়িয়েছে মেয়েটি। প্রতিবার ধরা পড়েছে, এরমধ্যে সংসারে সন্তান এসেছে। ডিভোর্স চেয়েও শেষ চেষ্টা হিসেবে সেশনে এসেছেন।
কারন খুজতে যেয়ে দেখা গেল, ছোটবেলা থেকে অসংখ্যবার যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হতে স্বামী-স্ত্রীর আন্তঃসম্পর্কজনিত স্ট্রাকচারটার সম্মানজনক সীমারেখার বৃত্তটি মেয়েটির জানা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলাকার সেই স্মৃতিগুলো অবচেতনভাবেই সে রূপান্তরিত করেছে বড়োকালে বহুগামিতার বৈধতাকে লালন করে।
আমি অবাক হলাম স্বামীটিকে দেখে। একটি মানুষ কত অদ্ভুত যত্নে, স্ত্রীর সবকিছু জেনেও পাশে থাকে নিয়ম করে সেশনে নিয়ে আসে। তখন মাঝে মাঝে মনে হয়, মৌসুমী ভৌমিকের গানের কথাগুলো কি আদৌ সত্যি?
“আমি শুনেছি
তোমরা নাকি এখনও স্বপ্ন দেখ,
এখনও গল্প লেখ গান গাও প্রাণ ভরে।
মানুষের বাঁচা মরা এখনও ভাবিয়ে তোলে
তোমাদের ভালবাসা এখনও গোলাপে ফোটে ।
আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ
তোমাদের কাছে এসে দু হাত পেতেছি।
আমি দু চোখের গহবরে শুন্যতা দেখি শুধু
রাত ঘুমে আমি কোন স্বপ্ন দেখি না
তাই স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু চোখ পেতেছি।”
পর্ব-৩০
ভদ্রলোকের বয়স ৫০, চাঁচাছোলা কথাবার্তা। প্রথম দিনই বললেন, ” ডক্টর আমি সাত ঘাটের জল খেয়ে এসেছি, এই সমস্যার কেউ সমাধান করতে পারেনি। এক বন্ধু আপনার পেশেন্ট ছিলো, সেই আপনার কথা ইন্সিস্ট করল, তাই যোগাযোগ করা, আপনি শুনে specifically yes or no বলবেন। বিদেশেও যেখানে ফল পাই নাই, আপনার থেকে বেশি আশা রাখি না।” আমি হাসলাম, ” তার মানে either pregnant or not pregnant, half pregnant বলে কিছু নাই।” ভদ্রলোক বেশ কড়া চোখেই তাকালেন। রসিকতা করছি কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন। সাধারণত এরকম আত্ম-অহংকারী, উচ্চ শিক্ষিত ও পদস্থ মানুষরা অন্যদেরকে নিচু চোখে দেখে। মনে করে যে কারো সাথে কথা বলেই তাদের ধন্য করে দিচ্ছে। এদের, I am ok, you are not ok অনেক বেশি হাই। ফলে খোঁচা মারার লোভটা সামলাতে পারলাম না। ভদ্রলোক সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন: “আমার সমস্যাটা একটা স্বপ্ন নিয়ে। আমি বারবার একই স্বপ্ন দেখি, ঘুম ভেঙে যায়। বুক ধরফর করে। প্রচন্ড ঘামে শরীর ভিজে যায়। হুড়মুড় করে ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠি।” আমি খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকের চোখের পিউপিল ক্রমশ বড় হচ্ছে, নাকের পাটা ফুলছে, গালের রঙ লালাভ হচ্ছে। পানির গ্লাসটা আগিয়ে দিলাম। লোকটি ঠোঁটের কোণা ঈষৎ বাঁকিয়ে বললেন, “বাংলাদেশের খোলা পানি পানি আমি খাইনা”। আমি বললাম, ” বাহ, বাংলাদেশের খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার ব্যাপারে আপনার মতামত কি?” ভদ্রলোক আবার আমার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে আমার মগজ ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করছেন। তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প। ভদ্রলোকের মূল সমস্যা হলো স্বপ্নে দেখেন, কিছু একটা ওনাকে তাড়া করছে। সেটা মানুষ বা পরিচিত কোন জন্তু নয়। তিনি প্রচন্ড ভয় পান। লুকোতে থাকেন। একপর্যায়ে চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যায়। দেশের বাইরে বিভিন্নখানে স্লিপ ল্যাবে পরীক্ষা করিয়েছেন। সবকিছু নরমাল। শারীরিক অসুস্থতা নেই, পেশাগত জায়গায় ভালো করছেন। অর্থনৈতিকভাবেও চমৎকার, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে কোনো থ্রেট নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। আমি বললাম, “আমাদের জীবনে বেসিক ইমোশন চারটা, আনন্দ, রাগ, দুঃখ, ভয়। আপনি কোন ইমোশনটা কনফ্রন্ট করছেন না? আপনার জীবনের কোন ঘটনাটিকে আপনি অস্বীকার করছেন?” ভদ্রলোক জোরেশোরে বললেন, ” অস্বীকার করার মতন কিছুই নেই।” আমি বললাম, “অবশ্যই করেছেন। হতে পারে সেটা অবচেতনভাবে তাই সচেতনভাবে হয়তো মনেও করতে পারছেন না। Unconscious mind is more powerful than the conscious brain. ” ওনার স্ত্রী পাশেই বসেছিলেন। ভদ্রমহিলা প্রথম থেকেই, স্বামীর দাম্ভিক আচরণে অস্বস্তিবোধ করছিলেন। আমি ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এমন কি ঘটেছে, যেটা নিয়ে উনি কথাই বলতে চান না? ঘটনাটিকে স্বীকৃতি দিতে চান না? মনে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না? জীবন থেকে মুছে ফেলতে চান? বা ফেলেছেন!” কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ভদ্রলোকের বাবা একটি ওল্ডহোমে আছেন। টার্মিনাল স্টেজ ক্যান্সার পেশেন্ট। বারবার ছেলেকে দেখতে চায়। কিন্তু ভদ্রলোক যায় না। কারণ এই বাবাই ভদ্রলোককে ছোটবেলায় তার মায়ের কাছে ফেলে অন্য মহিলাকে নিয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশের মতন একটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব কষ্ট করেই আজ উনি উপরে উঠেছেন। আমি বললাম, “আপনি বাবার সাথে দেখা করুন। সম্ভবত আপনার অবচেতন মন এই সিগনালটাই আপনাকে দিচ্ছে। কারণ আপনার ‘বাইরের আমি’ আজকে যতই সাকসেসফুল হোক, ‘ভেতরের আমি’, কিন্তু এখনও সেই ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি। সে আজও তার বাবাকে ভুলতে পারেনি। তার কষ্টগুলো জমাট বেধে গেছে। প্রকাশের ভাষা সে ভুলে গেছে। দেখুন না একটু দেখা করে, বরফ গলে কিনা?” বেশ কিছুদিন পরে, একটা চিঠি পেলাম। বাংলায় হাতে লেখা “ডক্টর, আমি বহু বছর বাংলা লিখি না, তাই হাতের লেখা বা বানান ভুল ক্ষমা করবেন। পৃথিবীর মাত্র দু’টি মানুষকে আমি চিঠি লিখেছি। একটি আমার মা, অন্যটি আমার স্ত্রী। আপনি তৃতীয় মানুষ যাকে চিঠি লিখলাম। শুধু একটা কথাই বলবো, আমি ও আমার স্ত্রী, আপনাকে ভালোবাসি। পুনশ্চ, বাবার সাথে দেখা করার পর থেকে, আমি আর স্বপ্নটা দেখি না। বাবা ওল্ড হোমে মারা গেছেন আজ ২ মাস। আপনার সাথে অভদ্রতা করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। বিনীত…”